সবচেয়ে দ্রুতগতির শিকারি প্রাণীর কথা বললে প্রথমেই যে নামগুলো চলে আসে তার মধ্যে চিতা, বাজপাখি, ঈগল অন্যতম। তবে এদের ছাড়িয়ে এমন একটি প্রাণী আছে, যা পেরেগ্রিন ফ্যালকন বা পেরেগ্রিন শাহিন বা রকেট বার্ড নামে পরিচিত। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো- এই পাখিটি চিতার চেয়ে পাঁচগুণ গতিতে তার শিকারকে আক্রমণ করতে পারে। শিকার ধরার সময় চিতার গতি যেখানে ঘণ্টায় ১১২-১২০ কিলোমিটার; সেখানে পেরেগ্রিন ফ্যালকনের গতি ৩০০-৩৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
পেরেগ্রিন ফ্যালকনের শিকারের ধরন বেশ ব্যতিক্রম। এরা সাধারণত একাকী শিকার করতে পছন্দ করে। ফ্যালকন যখন শিকার করে, তখন মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ব্যবহার করে। শিকারের সময় এরা ডানা শরীরের দুই পাশে চেপে ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার এবং তারচেয়ে বেশি বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারকে মুহূর্তেই ধরে ফেলে। পেরেগ্রিন শিকারকে ধরে তুলে নিয়ে যায় তার নির্ধারিত জায়গায়। সেখানে প্রথমে পালক তুলে ফেলে, তারপর মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। এরা সাধারণত কবুতর, জলজ পাখি, বক ও হাঁস শিকার করে খায়। খাবারের প্রয়োজনে বাদুড়, খরগোশ, ইঁদুর ইত্যাদি স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ; এমনকি মাছও শিকার করতে পারে। উড়ন্ত অবস্থায় বাদুড় বা অন্য পাখিদের ঘায়েল করতে সিদ্ধহস্ত এরা।
ফ্যালকন সাধারণত দৈর্ঘ্যে ৪২ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। এর ডানা ২৮ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.৬ সেন্টিমিটার, পা ৪.৯ সেন্টিমিটার এবং লেজ ১৪.৫ সেন্টিমিটার হয়। ছেলে আর মেয়ে পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। তবে মেয়ে পাখি আকারে তুলনামূলক বড় হয়। মাথা কালো, গালে গালপাট্টার মতো, চোখের তলায় সাদার ওপর কালোর ছোপ। ওপরের অংশে ধূসরের কালো টান আছে। চওড়া কাঁধ, ডানা চওড়া থেকে সরু। তীক্ষ্ম দৃষ্টি ক্ষমতার অধিকারী এদের চোখের রং গাঢ় বাদামি হয়ে থাকে। বুকের তলা থেকে তলপেট পর্যন্ত খুব সরু সরু কালচে টান রয়েছে। লেজ ছোট এবং ছড়ানো নয়। ভোর ও গোধূলিবেলায় এরা বেশি কর্মচঞ্চল থাকে। মার্চ থেকে মে মাস এদের প্রজননকাল। ডিম দেয় ৩-৪টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে ছানা বের হতে সময় লাগে ২৫-২৭ দিন।
পরিযায়ী এ প্রাণীর দেখা মেলে শীতকালে। পরিযায়নের সময়ও একাকীই থাকে। খুব কম সময়েই এরা জোড়াবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। নদী, হ্রদ, খাড়া-পাহাড়, জলাভূমি, প্যারাবন, অর্ধ মরুভূমি, পাথুরে প্রান্তরে বিচরণ করে এরা। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত উপমহাদেশ, চীন, ইন্দোনেশিয়ায় এদের দেখা যায়।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর আমেরিকায় ফসলের খেতে ডিডিটি নামক একধরনের কীটনাশক ব্যবহার শুরু হয়। ফসলের পোকামাকড় দমন করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। দেখা গেল ডিডিটি ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে; কিন্তু এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানা ছিল না ব্যবহারকারীদের। পাখিবিজ্ঞানীরা দেখলেন, এর প্রভাবে পেরেগ্রিন ফ্যালকন নামের এক জাতের পাখি কমে যাচ্ছে। পেরেগ্রিনের প্রধান খাবার ছোট পাখি। শস্যখেতের পোকাখেকো পাখির ওপর ডিডিটির প্রভাব কম হলেও পাখিখেকো পেরেগ্রিনের ওপর তীব্র প্রভাব পড়ে। এর ফলে পাখির ডিমের আবরণ পাতলা হয়ে যায় এবং ডিমে তা দেওয়ার সময় ডিম ভেঙে যায়। ফলে উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে এই পাখির সংখ্যা কমতে থাকে। পাখিটিকে একসময় বিপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তী সময়ে পাখিটিকে সংরক্ষণে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। ১৯৭০ সালে গঠন করা হয় ‘পেরেগ্রিন ফান্ড’ নামের একটি সংগঠন। ডিডিটি বন্ধের জন্য তারা বড় ধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করে। এ ছাড়া পাখিটি সংরক্ষণে কৃত্রিম প্রজননক্ষেত্র তৈরি করা হয়। পাখিটির গুরুত্ব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯৭২ সালে কীটনাশক ডিডিটি নিষিদ্ধ করে। পরে সংগঠনটির সহায়তায় প্রকৃতিতে ছাড়া হয় প্রায় চার হাজার পাখি। আস্তে আস্তে পেরেগ্রিন প্রকৃতিতে বাড়তে শুরু করে। বিপন্ন পাখি থেকে ১৯৯৯ সালে এটি ‘সংকটাপন্ন নয়’ তালিকায় স্থান পায়।
বাংলাদেশে ফ্যালকন পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১০। এর মধ্যে তিন জাতের ফ্যালকন আবাসিক, তিনটি প্রজাতি শীতের পরিযায়ী, তিন জাতের পাখি ইতস্তত ভ্রমণকারী পাখি ও এক জাতের ফ্যালকন হলো চলার পথের পাখি। এর মধ্যে পেরেগ্রিন ফ্যালকন শীতে দেশের সব প্রান্তেই দেখা যায়। ঢাকা শহরেও দেখা মেলে এদের। আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় এর অবস্থান আরও বেশি।
আরব শেখদের কাছে ফ্যালকনের কদর সবচেয়ে বেশি। ফ্যালকন দিয়ে তারা রাজকীয় শিকারে বের হয় প্রতি মৌসুমেই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh