রহস্যময় এক প্রাণী কালো চিতা। গহিন অরণ্যে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে কম, গাছের লতাপাতা আর অন্ধকারের আড়াল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে, অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর। কালো চিতা আসলে কী? বাংলাদেশের অরণ্যে কি এরা আছে? কখনো কি দেখেছেন কেউ?
বছর কয়েক আগের কথা। নতুন রাস্তা তৈরির কাজ চলছে বগা লেক থেকে কেওক্রাডংয়ের দিকে। ভাবলাম পুরোনো চেহারায় এই এলাকাটিকে পাওয়ার শেষ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। পাঁচ বছরের শিশু থেকে পঞ্চাষোর্ধ্ব নারী মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় একটি দল নিয়ে বগা লেক থেকে হাঁটা ধরলাম কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে। চলার পথে বিভিন্ন বন্য প্রাণীর ছবি ছাপানো একটি কাগজ দেখিয়ে স্থানীয় বমদের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলাম এদের সম্পর্কে।
কঠিন একটা চড়াই বেয়ে ওঠার পর পাহাড়ে আধ-সমতল একটি জায়গা। সেখানে সদ্য বাগান থেকে পেড়ে আনা কমলা, লেবুর শরবতসহ নানা কিছু নিয়ে বসেছে বমরা। বাঁশের একটি বেঞ্চের ওপর শরীর এলিয়ে মধ্যবয়স্ক এক বম দম্পতিকে কাগজটি দেখালাম। প্রথমেই তারা কালো চিতার ছবিটা দেখিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, পাহাড়ের গহিনে এটা আছে। তবে মেজাজ খুব চড়া, কাঠ কাটতে বা জুমে কাজ করতে গিয়ে কখনো দেখা পেয়ে গেলেও লুকিয়ে পড়েন। কিছুটা ধন্দে পড়লাম। সত্যি কী এদিককার পাহাড়ে এখনো আছে কালো চিতার আস্তানা?
কালো চিতা বা ব্ল্যাক প্যান্থার নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। তেমনি একে নিয়ে আছে নানা গল্পগাথা, কিংবদন্তি। তবে এরা চিতা বাঘেদের থেকে ভিন্ন কোনো প্রজাতি নয়। ব্ল্যাক ল্যাপার্ড নামেও চেনেন কেউ কেউ।
শরীরে মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে আমাদের গায়ের রং যেমন কালো হয়, তেমনি চিতা বাঘেদেরও। বিরল হলেও সাধারণ চিতা বাঘেদের একবারে দেওয়া কয়েকটা বাচ্চার মধ্যে একটা কালো হতে পারে। তাই বলে ভাববেন না, কালো চিতার সব বাচ্চাই কালো হবে। তাদের সাধারণ বাচ্চাও হতে পারে। কোনো চিড়িয়াখানায় কাছ থেকে কালো চিতা দেখার সুযোগ হলে কালো পশমের ভেতরে খুব আবছাভাবে চিতা বাঘের সাধারণ চেহারাটাও আবিষ্কার করবেন।
চিতা বাঘের সঙ্গে চেহারায় বেশ মিল থাকা জাগুয়ারেরা কালো হলে এদেরও ব্ল্যাক প্যান্থার বা কালো চিতা বলে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এবং আমাজনের জঙ্গল কিংবা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার অন্য জঙ্গলগুলোতে কদাচিত কালো চিতা দেখা গেলেও আফ্রিকায় মহাদুর্লভ। যেমন- ১৯০৯ সালে ইথিওপিয়ায় কালো চিতার দেখা পাওয়ার পর ২০১৯ সালে আবার সন্ধান মেলে কেনিয়ার এক সংরক্ষিত বনে।
কিন্তু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলের চিতা বাঘেদের কালো হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি কেন? বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে একটা ধারণা বেশ জনপ্রিয়। সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না এমন দুর্ভেদ্য, স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে যেসব জন্তু বাস করে, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গাঢাকা দেওয়ার প্রয়োজনেই তাদের চামড়া হতে হয় গাঢ় রঙের। মালয়েশিয়ার, বিশেষ করে ক্যানায়ার বন্য প্রাণী করিডর এবং বিনটাং হুজাও বন্য প্রাণী করিডরে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে কালো চিতাদের। শুনে চমকাবেন, সেখানে বরং সাধারণ চিতা বাঘের চেয়ে কালো চিতাই বেশি।
ভারতের জঙ্গলে কালো চিতার খবর মেলে মাঝে মাঝেই। বছর কয়েক আগে যেমন দার্জিলিংয়ে একটি কালো চিতার দেখা মিলেছিল। তেমনি ভারতের কর্ণাটকের কাবানি জঙ্গলের একটি কালো চিতা সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। আলোকচিত্রীরা এর বেশ কিছু দুর্দান্ত ছবিও তুলেছেন।
চলুন টাইম মেশিনে চেপে বসি। চলে যাই প্রায় তিন যুগ আগে। সেটা ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর। সুন্দরবন ও বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী খবর পেলেন বান্দরবানের আলীকদমে বাঘ দেখা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বেশ অস্থির তখন। সেনাবাহিনী সন্ধ্যা ৬টার পর সাধারণ যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল। তবে আব্দুল মোনেম লিমিটেড সেনাবাহিনীর কন্ট্রাক্টর হিসেবে ফাঁসিয়াখালী-আলীকদম সড়ক তৈরি করছিল। রাতের বেলা হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় খসরু চৌধুরী রাস্তা তৈরির কাজ করা খোলা ট্রাক্টরে চেপে ঘুরে বেড়াতেন বাঘের খোঁজে। দিনে পাহাড়ি ঝিরির তীরে খুঁজতেন বাঘের পায়ের ছাপ।
সে যাত্রায় বাঘের খোঁজ না পেলেও এক রাতে দেখা পেয়ে যান বাঘের চেয়েও দুর্লভ কালো চিতার, আলীকদম ব্রিজের কাছে। কাছাকাছি সময়ে কালো চিতার আরেকটি খবর মেলে বান্দরবানেরই রেমাক্রিতে।
২০১১ সালে বাঘের খোঁজে বান্দরবানের মোদক এলাকায় অভিযানের সময় আমাদের গাইড ছিলেন তালপাতার সেপাই এক বয়স্ক মারমা। ওই গাইড জানান, নব্বই-একানব্বই সালের দিকে রেমাক্রিতে একটি কালো চিতাকে ফাঁদ পেতে ধরে ফেলে স্থানীয় অধিবাসীরা। তারপর পিটিয়ে, তীর-ধনুক দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে।
কালো চিতা দেখার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে। তবে সেটা চিড়িয়াখানায়। ২০১৭ সালে গিয়েছিলাম দার্জিলিংয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত চিড়িয়াখানা পদ্মজা নাইডু জুওলজিক্যাল পার্কে ঢু মারি। সেখানেই দেখি ওখানকার অন্যতম আকর্ষণ কালো চিতাকে।
কালো চিতা নিয়ে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা আছে বিখ্যাত শিকারি কেনেথ এন্ডারসনেরও। সেটা ১৯৩৪ সালে। ভারতের ব্যাঙ্গালোর (বর্তমান বেঙ্গালুরু) থেকে মাইল পঞ্চশেক দূরে সংরক্ষিত বন লাগোয়া একটি গ্রাম শিবানিপল্লি। গভীর অরণ্যের কারণে ছোট্ট গ্রামটার আশপাশ চিতা বাঘেদের রীতিমতো স্বর্গরাজ্য। সেখানেই হঠাৎ হাজির হয় ওটা। আগে কালো রঙের চিতা বাঘ না দেখা কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীর মনে জন্ম নেয় নানা গুজবের।
শিবানিপল্লির কালো চিতার খবর পেয়ে ওটার পিছু নেন এন্ডারসন। প্রথম মুখোমুখি হোন এক রাতে। টর্চের আলোয় ওটার চোখ জোড়া ছাড়া কিছুই নজরে পড়েনি তার। তারপরই জড়িয়ে পড়েন এক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারে।
সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ল্যাফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এস উডের লেখা বইয়ে ওই সময় তখনকার বার্মার পেগু জেলায় তার ভাইয়ের দুটি কালো চিতা শিকারের বর্ণনা আছে। সিলেটের সিভিল সার্জন থাকা অবস্থায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করেন। ওই সময় হবিগঞ্জের এসডিও (সাব ডিভিশনাল অফিসার) সেখানকার এক গ্রামের কুঁড়েতে একটি কালো চিতা আস্তানা গেড়েছে বলে খবর পান। সেখানে গিয়ে চালায় উঠে খড় সরিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন অদ্ভুত সুন্দর প্রাণীটিকে। এটি অবশ্য ১০০ বছর আগের কথা।
এবার আরেকটু কাছাকাছি সময়ের দিকে যাই। সেটা ১৯৭৬-৭৭ সাল। পরিচিত এক বড় ভাই বাবার চাকরির সুবাদে থাকতেন কক্সবাজারে। তখন তার বয়স ৮-৯। হিমছড়ির অরণ্যে উঁচু উঁচু সব গাছ আর তাদের ডালা-পাতা এবং লতাগুল্ম মিলিয়ে দিনেই রাত নামত। ওই বয়সেই সেই মইনুল ভাই স্থানীয় কাঠুরেদের সহায়তায় একদিন হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে গিয়েছিলেন হিমছড়ির সবচেয়ে খাড়া পাহাড়টিতে। ওই লোকগুলোই তাকে জানায় পাহাড়ের গহিনে আস্তানা গাড়া কুচকুচে কালো চিতা বাঘের কথা। হনুমান যার প্রিয় শিকার।
২০২১ সালে সিলেটের কানাইঘাটে গেলে এক চা-বাগানের মালিক পরিবারের সদস্য ইউসুফ ওসমান দশ-বারো বছর আগে সেখানকার ভারতীয় সীমান্তবর্তী অরণ্যে একটা কালো চিতা ফাঁদে ধরা পড়ার ঘটনা বলেছিলেন। অবশ্য ওটাকে বাঁচানো যায়নি। তখনই মনে পড়ল কাছাকাছি সময়ে ওই এলাকায় কালো সোনালি বিড়াল ধরা পড়ার কথা শুনেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক মুনতাসীর আকাশের কাছে। হতে পারে ইউসুফ ওসমান যে কালো চিতার কথা বলেছেন, সেটা সোনালি বিড়ালের কালো রূপভেদ। সাধারণের চোখে এই দুটোকে আলাদা করা কঠিন।
আমার ধারণা পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-পাহাড়ে শুধু চিতা বাঘ নয়, এখনো আছে মহাদুর্লভ কালো চিতার আস্তানাও।
বাঘাইছড়ির এক চাকমা তরুণের মুখে শোনা ঘটনাটি ওই আশাকে জোরালো করে। বেশিদিন কাসালং রিজার্ভের ভেতরে একটি জায়গায় গরু চরাত স্থানীয় বাসিন্দারা। ২০২৩-এর শেষদিকে সেখানে হানা দিয়েছিল একটি রাগি কালো চিতা। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা একে মেরে ফেলে। ঘটনাটা শুনে মনটা কেঁদেছিল। আহ, ওরা জানলই না কেমন দুষ্প্রাপ্য একটি প্রাণীকে মেরে ফেলেছে। তবে স্থানীয়রা বলে কাসালং সংরক্ষিত বনের ভেতরে এখনো নিজের কালো রঙের সুবিধা নিয়ে গাছপালার ঘন আচ্ছাদনের আড়ালে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ায় কালো চিতারা। হতেই পারে! নিঃশব্দে, গাঢাকা দিয়ে চলাফেরার কারণে এর পরিচয় যে ঘোস্ট অব দ্য ফরেস্ট বা জঙ্গলের প্রেতাত্মা ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh