২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে কিয়েভসহ ইউক্রেনের অনেক এলাকার নাগরিক এমন বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। কারণ সেদিন রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি দেশের উপর আরেক দেশের সবচেয়ে বড় হামলা। হামলার পরপরই ইউক্রেনে সামরিক আইন জারি করা হয়।
ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানোর কথা বলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনেৎস্ক ও লুহানস্ক এলাকা দখলের লক্ষ্যের কথা বলেছিলেন। দনেৎস্কের মারিউপল শহরের বাসিন্দারা কয়েক সপ্তাহ বাড়ির বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছবিতে মারিউপল থিয়েটার ভবন দেখা যাচ্ছে যেখানে আশ্রয় নেয়া কয়েকশ মানুষ রাশিয়ার হামলায় প্রাণ হারান।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট দেখা দেয়। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মতে, আশি লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পোল্যান্ড একাই প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেয়।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেনের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে দিতে সমর্থ হয় ইউক্রেনের সেনাবাহনী। কিয়েভ দখল করার রাশিয়ার পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়। সেই সময় কিয়েভের কাছে বুচা এলাকায় রাশিয়ার নৃশংসতার চিহ্ন দেখা যায়। সেখানকার নাগরিকদের অত্যাচার ও হত্যার চিত্র বিশ্ববাসীকে চমকে দেয়। রুশ বাহিনীর হাতে বুচায় ৪৬১ জন হত্যার শিকার হন বলে কর্মকর্তারা জানান।

এপ্রিলে ইউক্রেনের ডনবাস এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এলাকা ছাড়তে সেখানকার ক্রামাটর্সক শহরের স্টেশনে জড়ো হয়েছিলেন অনেকে; কিন্তু সেখানে রাশিয়া হামলা চালালে ৬১ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন ১২০ জন।

হামলা থেকে বাঁচতে অনেক ইউক্রেনীয় পাতাল রেলস্টেশন বেছে নিয়েছিলেন।

যুদ্ধের প্রথম দিনই কৃষ্ণ সাগরের স্নেক আইল্যান্ড দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া। সেই সময় ইউক্রেনীয় সেনাদের আত্মসমর্পন করতে না চাওয়ার একটি অডিও ভাইরাল হয়। জুনে ইউক্রেন জানায়, তারা স্নেক দ্বীপ থেকে রুশদের সরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে।

এখন পর্যন্ত যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা কত তা অস্পষ্ট। জাতিসংঘ বলছে, কমপক্ষে সাত হাজার ২০০ সাধারণ নাগরিক মারা গেছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। ইউক্রেনের কত সেনা মারা গেছেন তাও জানা যায়নি। ডিসেম্বরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের একজন উপদেষ্টা জানান, সংখ্যাটি ১৩ হাজার পর্যন্ত হতে পারে৷ নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া যায়নি।

যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা হবে কিনা তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হাইমার্স রকেট লঞ্চার পায় ইউক্রেন। এটা দিয়ে যুদ্ধরত রাশিয়ার সেনাদের কাছে পুনরায় অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে বাধা দেয়া সম্ভব হয়। এছাড়া এই লঞ্চারের কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছুটা রুখে দাঁড়াতে সমর্থ হয় ইউক্রেন।

সেপ্টেম্বরের শুরুতে খারকিভে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণ চালায় ইউক্রেন। হঠাৎ এই আক্রমণের পর রুশ সেনারা অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায়। দক্ষিণের খেরসন শহর মুক্ত করতে সমর্থ হন ইউক্রেনের সেনারা৷ ছবিতে ইউক্রেনের সেনাদের দেখে উল্লসিত ইউক্রেনীয়দের দেখা যাচ্ছে।

অক্টোবরের শুরুতে ক্রাইমিয়া ব্রিজে বড় বিস্ফোরণ হয়। এতে ব্রিজের কিছু অংশ ভেঙে যায়। রাশিয়া বলছে, বিস্ফোরকবাহী একটি ট্রাকের কারণে এমন হয়েছে। আর কিয়েভ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি।

ক্রাইমিয়া ব্রিজে বিস্ফোরণের কিছুদিন পর ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা শুরু করে রাশিয়া। সে কারণে লাভিভ থেকে শুরু করে খারকিভ সব জায়গায় বিদ্যুতের অভাব দেখা দেয়। এরপর থেকে রাশিয়া জ্বালানি অবকাঠামোতে নিয়মিত হামলা করে এসেছে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রতিদিন ভিডিও বার্তা দেয়া শুরু করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। তার এই বার্তা ইউক্রেন ছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বের নেতা ও নাগরিকদের আকৃষ্ট করে। সে কারণে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমের সমর্থন বেড়েছে। দেশটি এখন ইইউর সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা করছে।

যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশ ইউক্রেনকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের মানবিক, সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। তবে রাশিয়ার উদ্বেগের কথা ভেবে ইউক্রেনকে লেওপার্ড ২ ট্যাঙ্ক দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনকে ঐ ট্যাঙ্ক দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ট্যাঙ্কটি জার্মানির তৈরি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছিল। জাতিসংঘের হিসেবে, এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার সেনা ও সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। ছবিতে দেখে নিন ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর...