শামসুর রাহমান সময়ের নির্মোহ ভাষ্যকার

বাংলাদেশের জন্ম-প্রক্রিয়াসহ নানান উত্থান- পতনে যে কবির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত- তিনি শামসুর রাহমান। সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন দেশের অন্যতম প্রধান কবি। তার কবিতার অমিয়ধারা এখনো দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে সাহিত্যাঙ্গনের সমস্ত প্রশাখায়।

বস্তুত পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু থেকে কেমন ছিল ঢাকার পরবর্তী সময়গুলো? সময়-যাপনের নানাবিধ চিত্র ধরা পড়েছে কবি শামসুর রাহমানের লেখাজোকায়। তিনি পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। যে কারণে সময়ের কালস্রোতের প্রবহমান ধারাকে দর্শন করেছেন খুব কাছ থেকে। সেসব অভিজ্ঞতা থেকেই লিখতেন কবিতা। বায়ান্নর ভাষা সংগ্রাম থেকে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে মিছিল, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের আতংকিত প্রহর বাঙালির গণসংগ্রামের ইতিহাসের সব সিঁড়ি পেরিয়ে ‘পাড়াতলীর বাচ্চু’ হয়ে উঠেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। জনমনের আবেগ ধারণ ও অনুধাবনের ক্ষমতা তার ছিল অসীম, ছিল মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। সর্বোপরি সরল বাক্য বিন্যাসে নির্মিত তার মহৎ কবিতা বুঝতে কষ্ট হতো না কারও।  তার কবিতা জনপ্রিয়তার এটা একটা বড় কারণ। কবিতায় সময়ের অভিঘাত তুলে ধরার কারণে তিনি উঠেছিলেন সময়ের নির্মোহ ভাষ্যকার। তার কবিতায় ভেসে উঠত স্বদেশের নানাবিধ অনুষঙ্গ। গদ্যকবিতায় পুঁতে দিতেন এমন জাদু যে, পাঠকের বিমোহিত না হওয়ার উপায় ছিল না। কে ভুলতে পারবে ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতার বয়ান! ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি অল্প কথার মালা গেঁথে খণ্ড খণ্ড চিত্রে বাক্সময় করে তুলেছিলেন তিনি। একটিও কঠিন শব্দ নেই তার এই কবিতায়। দুর্বোধ্যতা-আড়ালও ছিল অনুপস্থিত। যে জন্য কবিতাটি চুম্বকের মতো টেনে নিয়েছিল পাঠককে? শামসুর রাহমানের সৃষ্টিশৈলীতে আছে কাব্যময় আবেশ, যে আবেশ লহমায় অন্যদের দ্রবীভূত করতে সক্ষম।  তার লেখা ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটিকে এমন নিদারুণ ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন- প্রত্যেকের বুকেই যেন দ্রোহের শব্দাবলির মাধ্যমে পতাকা হয়ে উঠেছিলে সেই রক্তমাখা শার্টটি। আসাদের রক্তমাখা শার্টটি হয়ে উঠেছিল আগুনের ফুলকি ও দ্রোহের প্রতীক।

তার সহজবোধ্য কবিতায় আছে একধরনের শক্তি, যার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ না করে উপায় থাকে না। বিশেষ সময় বা উপলক্ষকে সামনে রেখে কোনো কোনো কবিতা রচিত হলেও শিল্পগুণেই সেটা হয়ে উঠেছিল সময়ের কণ্ঠস্বর বা চিরকালের কবিতা। 

এরশাদ শাহীর আমলে প্রকাশিত তার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। নামটি যেন ক্রমান্বয়ে ‘চিরন্তন’ হয়ে উঠেছিল ইতিহাসে, মননে। সব ধরনের দুর্যোগকালের জন্য প্রাসঙ্গিক এ-নাম আজও প্রবাদতুল্য।

কখনো আমার মাকে কবিতায় কবি কী অবলীলায় বলে যান, কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি...। এ-কথা শুনে পাঠকের বুকেও তীব্র মোচড় জাগে! এই দুঃখ-দারিদ্র্যজীর্ণ বঙ্গে মায়েদের দুঃখ-কষ্টের কাতর অভিব্যক্তিই সত্য, গান গাইবার সুখী মা বেশি পাওয়া যায় না। এই মা তাই সহজেই হয়ে ওঠেন সর্বজনীন মা। দুর্ভাগা সন্তানের জননী। একইভাবে তার লেখা আরেকটি পঙ্ক্তি পাঠকের পক্ষে ভোলা সহজ নয়- ‘ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি গোলাপ নেব।’ শুভবোধসম্পন্ন মানুষ বরাবরই গোলাপ নিতে চায়, কিন্তু ঘাতক যে পথ ছাড়ে না! স্বীয় হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পথে পথে বিছিয়ে রাখে কাঁটা। এসব বিষয় তিনি কবিতায় এনেছেন সূক্ষ্ম নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে। তার সময়কালে যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর সঙ্গে নিজের যাপিতজীবনকে মিলিয়ে বলেছেন- ‘আমরা যখন ঘড়ির কাঁটার মতো মিলবো রাতের গভীর যামে/তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা, পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে। এভাবেই স্বদেশ ও বিশ্বকে একসুতোয় বেঁধে দেন কবি। কাব্যগ্রন্থগুলোর নামকরণেও যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তার প্রথম দিককার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের নাম- প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, বন্দী শিবির থেকে, বিধ্বস্ত নীলিমা, রৌদ্র করোটিতে, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, খণ্ডিত গৌরব। 

প্রগতিশীলতা চিন্তা-চেতনা লালনের কারণেই মৌলবাদী হামলার মুখেও পড়েছিলেন। রোষানলে পড়েছিলেন স্বৈরাচারের। নানা রকম প্রলোভনও দেখানো হয়েছিল তাকে। কিন্তু দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তরে রেখেছিলেন বলেই কোনো ফাঁদে আটকা পড়েননি তিনি। সব সময়েই তিনি দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ রেখে গেছেন। মানুষের সংকট থেকে গণসংগ্রাম তিনি সবখানে ছিলেন সরব। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন গল্প উপন্যাস নাটক স্মৃতিকথাও। শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তার  ছিল বিশেষ খ্যাতি। 

শামসুর রাহমান কি অপঠিত হয়ে উঠছেন? ইদানীং এমন পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন কেউ কেউ! তার কবিতায় এমন সব বিষয়কে তিনি শিল্পরূপ দিয়েছেন যা আজ পর্যন্ত পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক। একজন কবির জীবনে এটা এক বিশেষ পাওয়া। সময়ের এই নির্মোহ ভাষ্যকারের জন্য জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh