সাদিক আব্দুল্লাহ ও জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন না পাওয়ার ‘নেপথ্যে’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৩, ২২:৫৭
বরিশালের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং গাজীপুরে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: সংগৃহীত
দেশের পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে এবার দলীয় টিকিট পাননি বরিশালের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং গাজীপুরে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। আর এ নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ। তবে মনোনয়ন না পাওয়ার নেপথ্যে এই দুজনের বিরুদ্ধে থাকা নানা অভিযোগ উঠে এসেছে।
জানা যায়, বরিশাল সিটি করপোরেশনে বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে তার চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোয়নয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে বরিশালের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করলো বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে গত ৫ বছরে একাধিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের বিরোধ হয়েছিল এবং যার জের ধরে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার লাঞ্ছিত হবার ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিলে পরবর্তিতে সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠে।
বিশেষ করে দলের অন্যান্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা, প্রশাসনের সাথে উচ্ছৃংখল আচরণ করা– এক ধরণের বলপ্রয়োগনীতির মাধ্যমে বরিশাল পরিচালনার অভিযোগ উঠেছিলো সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে।
এই সমস্ত অভিযোগগুলোর প্রেক্ষিতেই সাদিক আব্দুল্লাহকে এবার মনোনয়ন দেয়া হয়নি বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য বলেছেন, সাদিক আব্দুল্লাহর অতীত কর্মকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে ভোটারদের কাছে ভুল বার্তা যাবে এবং আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেয় এমন ধারণা পাওয়া যাবে।
সাদিক আব্দুল্লাহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর পুত্র। বরং তার বদলে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর ছোটভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে মনোনয়ন দেয়া হলো।
বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল। হাসনাত আব্দুল্লাহর কারণে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ দীর্ঘদিন রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়েছিলেন। এবং সেখান থেকেই শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিয়ে চমক সৃষ্টি করলেন।
অন্যদিকে গাজীপুর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আলোচিত নাম জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া এই মেয়র তরুণ বয়সে বেশ জনসমর্থন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন দলের হাইকমান্ডকে।
যে কারণে ২০১৮ সালে হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে মেয়র হওয়ার আগেই দেশজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে দল থেকে বহিষ্কৃত এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ হারানোর পর অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাহী কমিটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর অনেকটা চাঙা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আবারও মনোনয়ন পাবেন- এমন আশায় খোদ জাহাঙ্গীরও অপেক্ষায় ছিলেন। তার কর্মী-সমর্থকরাও আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এই সিটিতে মেয়র পদে মহানগর সভাপতি আজমত উল্লা খানকে বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ভোটে লড়তে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী হয়ে ওঠা জাহাঙ্গীর আলমের শেষ আশা পূরণ হলো না। তবে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন কি না সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। ইতোমধ্যে তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জনগণ চাইলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন। তবে দল থেকে বহিষ্কার হয়ে বিপদে পড়া জাহাঙ্গীর ক্ষমা পেয়ে দলের ফেরার পর আবার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করবেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে বলে জানা গেছে।
দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরকে আজমত উল্লার পক্ষে ভোটের মাঠে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাহাঙ্গীর আলমের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তির কারণে সেই ভিডিওর জেরে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বরখাস্ত হওয়ার পর পুরোদমে রাজনীতির বাইরে চলে যান ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা। নেতাকর্মী ও বিশাল সমর্থকরাও কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পরে অবশ্য ক্ষমা চেয়ে দলের কাছে আবেদন করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক।
গত ১৭ ডিসেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত শতাধিক নেতাকর্মীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এসময় জাহাঙ্গীরও ক্ষমা পাওয়াদের তালিকায় ঠাঁই পান।
গত ১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ। এরপরই মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেন জাহাঙ্গীর ও তার ভক্তরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের প্রভাবশালী এক নেতার কারণে আওয়ামী লীগ তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। পরে জাহাঙ্গীর আবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য জোর তদবির শুরু করেন। দলের হাইকমান্ডের কাছে ওই নেতা জাহাঙ্গীরের পক্ষে কথাবার্তাও বলেন। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কাজ হয়নি। প্রবীণ রাজনীতিক আজমত উল্লাহ খানকে বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
গাজীপুর সিটিতে আজমত উল্লা খান আর জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে টানাটানির শুরুটা ২০১৩ সালে। ওই বছর আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র আজমত উল্লা খানকে। সেই নির্বাচনে শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর সদর উপজেলার সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান তখন মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে প্রকাশ্যে কান্না করেছিলেন। সেই কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল তার সমর্থক নেতাকর্মীদের মন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লার বিপুল ভোটে হেরে যাওয়ার পেছনে কেউ কেউ জাহাঙ্গীরকে দায়ী করেন।
তবে পাঁচ বছর অপেক্ষার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে তরুণ নেতা জাহাঙ্গীরকেই বেছে নেয়। সেই নির্বাচনে আজমত উল্লা প্রার্থী হতে চাইলেও দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিপুল জনপ্রিয়তা দেখাতে সক্ষম হন জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুরে তিনি অনেকটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে উঠছিলেন। এর মধ্যেই একটি অডিও ফাঁসের মাধ্যমে তার রাজনীতির উত্থানে ছন্দপতন ঘটে। সম্ভাবনাময় নেতা জাহাঙ্গীর আবার রাজনীতির পুরনো ছন্দে ফিরতে পারবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
প্রসঙ্গত, শনিবার (১৫ এপ্রিল) আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় পাঁচ সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সকাল ১১টায় গণভবনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের পাঁচ সিটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন- গাজীপুরে অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, বরিশালে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন ও খুলনায় তালুকদার আব্দুল খালেক।
