বরিশালে মেয়র প্রার্থীকে ছাড়াই আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা

খান রুবেল, বরিশাল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ২০:৩২
-6470c3134a2b9.jpg)
বরিশালের গৌরনদী পৌরসভা চত্বরে সিটি নির্বাচন উপলেক্ষ্যে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা। ছবি: বরিশাল প্রতিনিধি
দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত মেয়র প্রার্থীকে ছাড়াই বিশেষ বর্ধিত সভা করেছে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় টিম। প্রার্থী ঘোষণার এক মাস ১১ দিন পর আজ শুক্রবার (২৬ মে) বিকেলে বরিশালের গৌরনদী পৌরসভা চত্বরে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কেন্দ্রীয় টিমের প্রধান ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বড় ভাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র সভাপতিত্বে বর্ধিত সভায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমানসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
তবে এ বর্ধিত সভায় ছিলেন না আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ও তার অনুসারী জেলা এবং মহানগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এমনকি সভায় দেখা যায়নি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকেও।
তবে যাকে ঘিরে বর্ধিত সভার আয়োজন সেই মেয়র প্রার্থীর অনুপস্থিতি স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভাজন আরও প্রকট হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
যদিও খোকন অনুসারীরা বলছেন, শুক্রবার প্রতীক গ্রহণ থেকে শুরু করে দিনভর নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিলেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। এ কারণে গৌরনদীতে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত হতে পারেননি তিনি।
জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের নাম ঘোষণা করে দলের মনোনয়ন বোর্ড।
পরবর্তীতে গত ২০ এপ্রিল বড় ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং ভাজিতা বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে ছাড়াই কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বরিশালে আসেন খোকন সেরনিয়াবাত।
এদিকে, খোকন সেরনিয়াবাতকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ায় বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীরা নতুন করে সক্রিয় হতে শুরু করে। এমনকি তারা মেয়র প্রার্থীকে ঘিরে নগরীতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাদিক অনুসারীদের দখলে থাকা অনেক স্থাপনা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। দলের এই অভ্যান্তরীণ কোন্দল শেষ পর্যন্ত সহিংস রাজনীতিতে গড়ায়।
যদিও সিটি নির্বাচনকে ঘিরে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ঘুঁচিয়ে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে গত ১৭ মে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের টিম গঠনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার নির্দেশে ওইদিনই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় টিম। যেখানে দলের দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাছিমও রয়েছেন।
বর্ধিত সভার দিনেই দলের দপ্তর সম্পাদক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে ২৬ মে ও ১ জুন বিশেষ বর্ধিত সভার সময় ঘোষণা করা হয়।
পৃথক দুটি বার্ধিত সভায় মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত উপস্থিত থাকবেন বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল। তবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার বর্ধিত সভায় অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে দেখা যায়নি এই প্রার্থীকে।
কেন্দ্রীয় টিমের প্রধান আবুল আহাসানাত আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে বর্ধিত সভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম, বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমসহ জেলা ও মহানগর, উপজেলা, পৌর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও দলীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদীয় বোর্ড আমার ছোট ভাই, যিনি ১৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, যেহেতু সাদিক (বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ) এখানে মেয়র ছিল, তার কিছু অনুসারী বা ভক্ত আছেন, তাদের মনে হয়তো কষ্ট লাগছে। কিন্তু এই কষ্ট ভুলে গিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোনোভাবে, যে করেই হোক খোকন সেরনিয়াবাতকে জয় করাতে হবে। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলেন, আজকে যদি আমাদের এই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হয়, তাহলে এই বরিশালে দল-মত নির্বিশেষে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে খোকন সেরনিয়াবাতকে নৌকায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই নির্বাচনই করবো। অবশ্যই আমাকে আপনারা সহযোগিতা করবেন।
তিনি বলেন, আগেও আমি অনেক নির্বাচন করেছি। আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা, তা আমি কাজে লাগাতে চাই আপনাদের মাধ্যমে। আপনারা আমার সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যাতে বরিশাল সিটির মেয়র নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করতে পারি, সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আপনারা সেই কাজ করবেন।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য জানান, প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এক মাসের বেশি হয়ে গেছে। অন্য সিটি করপোরেশনগুলোতে মনোনয়ন ঘোষণার দুই-চারদিনের মধ্যেই বর্ধিত সভা করেছে স্থানীয় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। অথচ বরিশালে তা হয়নি, একমাস পরে এই বর্ধিত সভা কি উপকারে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে শুক্রবার প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের দিন থাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল-মিটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেন। তাই দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটিসহ অন্য কোনো নেতাকর্মীই বরিশাল থেকে গৌরনদী যেতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেননি। তাই প্রার্থীও বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণ করেননি।
এ প্রসঙ্গে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য লস্কর নুরুল হক বলেন, আমি তো আওয়ামী লীগের কেউ না, আমাকে ওই বর্ধিত সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাই আমি সেখানে যেতে পারিনি।
বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, শুক্রবার প্রার্থীর দিনভর নানা কর্মসূচি ছিলো। সকাল ১০টায় তিনি নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রতীক গ্রহণ করেছেন। বেলা সাড়ে ১২টায় নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাউজিং এস্টেটের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছেন। বিকেল ৪টায় নগরীর কলাডেমা কাজীবাড়িতে উঠান বৈঠক করেছেন। এছাড়া সন্ধ্যা ৭টার পর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের রিফিউজি কলোনীতে নির্বাচনী সভা করেন। এসব কর্মসূচিতে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন।
প্রার্থীর নির্বাচনের প্রধান এজেন্ট মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করীম বলেন, আজ সারাদিন আমার ব্যস্ততা ছিলাম। সকালে প্রতীক আনতে নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় যেতে হয়েছে। সেখানে প্রার্থী নিজেও ছিলেন। তাছাড়া দিনভর আরও অনেক কর্মসূচি ছিলো। যে কারণে আমি বর্ধিত সভায় যেতে পারিনি। তবে প্রার্থী কেন বর্ধিত সভায় যাননি সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
বর্ধিত সভায় না যাওয়ার বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগ মনোনীন মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, এটা জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ডাকা বর্ধিত সভা নয়। সভা ডেকেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আর প্রার্থীর সাথে কথা বলেই বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে। এই সভার মূল নায়ক হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি কেন আসেননি সে বিষয়টি আমি অবগত নই।