
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছবি: সংগৃহীত
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ্যে আসে। নানাভাবে দলটির নেতারা ব্যর্থ হয় রাজপথে সহিংসতা ও আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে। এছাড়া দলটির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদীরা সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলে। বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণে সমালোচিত হন অনেক নেতা। এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলটির সাবেক ছাত্রনেতাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন।
গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের সাবেক ছাত্রনেতাদের তোপের মুখে পড়েন। এ সময় সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ ‘ভূয়া ভূয়া’ বলেও স্লোগান দেন।
প্রসঙ্গত, দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। তবে মতবিনিময় সভায় কথা বলতে না দেয়ায়, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত সাবেক নেতারা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদীয়মান তরুণ নেতাদের নিয়ে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। বেলা ১১টায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকেও আগের দিন জানানো হয়।
এ সভায় সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময় সভার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগের তিন/চারশত সাবেক নেতা দলীয় কার্যালয়ের দোতলার সম্মেলনকক্ষে উপস্থিত হন। এর মধ্যে সংসদ সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারা ছিলেন। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা মতবিনিময় না করেই গণমাধ্যমের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে শুরু করেন ওবায়দুল কাদের।
ছাত্রনেতারা আরও জানান, সভায় ওবায়দুল কাদেরকে কোটা আন্দোলন নিয়ে বক্তব্যের কারণে (মাঠ দখলের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট) তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সাবেক ছাত্রনেতারা বলেন, আপনাদের (মন্ত্রী) কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যের কারণে এমন পরিস্থিতিত সৃষ্টি হয়েছে। মন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা কোটা আন্দোলন সমর্থন করে আর আপনারা আওয়ামী লীগের নেতা!
এছাড়া সাবেক ছাত্রনেতাদের রোষানলে পড়েন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক। তাকেও হেনস্তার চেষ্টা করা হয়। কয়েকজন নেতা তেড়ে যান তার দিকে। তারা বলেন, রাজ্জাক এখানে কেন? তার ছেলে কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সরকারবিরোধী পোস্ট করেছেন! কোটা আন্দোলনের সহিংসতার সমর্থন করে দেশপ্রেমী সেজেছেন। সাবেক ছাত্রনেতাদের তীব্র সমালোচনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন আবদুর রাজ্জাক।
আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন এমন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। পরে তা হট্টগোলে রূপ নেয়। কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, মতবিনিময় সভা ডেকে সংবাদ সম্মেলন করছেন কেন? তাহলে আমাদের ডাকলেন কেন? আগে আমাদের কথা শুনবেন, আলোচনা করবেন, তারপর ব্রিফ করেন। তা না করে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলা শুরু করে দিলেন। মিডিয়ায় নিজেকে তুলে ধরতে এতো পাগল হন কেন?
জানা যায়, এর আগে একাধিকবার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যৌথসভা ডেকে ওবায়দুল কাদের বক্তৃতা করে সভা শেষ করে দিয়েছেন। অন্যরা কোনো বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাননি। এমনকি দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক ডেকেও একাই বক্তৃতা করে বৈঠক শেষ করার নজির আছে ওবায়দুল কাদেরের। এতে ওই নেতারা বিক্ষুব্ধ হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তারা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে ওবায়দুল কাদের নিজে বক্তৃতা করে চলে যাবেন। বৈঠকে এসে তাই দেখতে পান। এতে নেতারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
সাবেক ছাত্রনেতারা আরো বলেন, হট্টগোল শুরু হলে প্রথমে ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা যায়, ‘কে, কে, থামো।’ কিন্তু এরপরও হট্টগোল আরো বেড়ে যায়। এরপর সংবাদ সম্মেলন অন্যান্য দিনের মতো দীর্ঘ না করে সভাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন ওবায়দুল কাদের। এ সময় পেছনে বসা ছাত্রলীগের সাবেক একাধিক নেতা ‘ওবায়দুল কাদের ভূয়া, ওবায়দুল কাদের ভূয়া’ বলে আওয়াজ তোলেন। তারপর অনেকেই ‘ভূয়া, ভূয়া’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তোপের মুখে নিজেকে রক্ষা করতে সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় না করেই আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিজের কক্ষে ওবায়দুল কাদের ঢুকে পড়েন।
অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও যার যার মতো করে চলে যান। এ সময় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের নিচতলা ও সামনের সড়কে থাকা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও ‘ভূয়া, ভূয়া’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। ঘণ্টাখানেক ধরে চলে এই স্লোগান।
মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।
এদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দলের ভেতরেও নানাভাবে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওবায়দুল কাদেরকে। অনেক কেন্দ্রীয় নেতা প্রকাশ্যে বলছেন, উনার (ওবায়দুল কাদের) জন্যই আজকে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলা করে তুলেছেন। তার দায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে অবস্থা আরও ভয়াবহ দিকে মোড় নিবে।তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই কান্ডজ্ঞানহীন নেতাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আহ্বান জানান।