ফাইল ছবি
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের নতুন রাজনৈতিক পটভূমির হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কার যেমন হচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণ করছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও তাদের পরিকল্পনাকে নতুন করে ঢেলে সাজাচ্ছেন।
জানা গেছে, বর্তমানে চার ইস্যুতে সর্বাধিক মনোযোগ বিএনপির। এগুলো হচ্ছে- ১. আন্দোলনে হতাহতদের খোঁজ নেওয়া এবং সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ব্যাপকভিত্তিক ত্রাণ বিতরণ, ২. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, ৩. নৈরাজ্য প্রতিরোধ ও দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং ৪. ঐক্যবদ্ধভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা।
এ বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে, উৎফুল্ল মনোভাব তৈরি হয়েছে। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা দিয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। বিশেষ করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশকিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য যে কোনো ধরনের দখল-চাঁদাবাজির বিরেুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরই মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
হতাহতদের খোঁজখবর:
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের খোঁজখবর নিচ্ছে বিএনপি। দলটির পেশাজীবী সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ) এবং বিশেষ সেল ‘আমরা বিএনপি পরিবার’র মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি শতাধিক আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার পাশাপাশি আর্থিক সহযোগিতা পৌঁছে দিয়েছেন। জেডআরএফের পুনর্বাসন কমিটির আহ্বায়ক ডা. শাহ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ জানান, তিনি তারেক রহমানের পক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ সেলের উপদেষ্টা প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল ও আহ্বায়ক আতিকুর রহমান রুমন জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত প্রায় ২০০ জনের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহত দুজনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন জেডআরফের সদস্য প্রকৌশলী আমিনুর ইসলাম।
বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা:
দেশের পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। এজন্য একটি কেন্দ্রীয় ত্রাণ কমিটি এবং ২৪ সদস্যবিশিষ্ট ত্রাণ সংগ্রহ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ত্রাণ সংগ্রহ কমিটির প্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন গতকাল বলেন, বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় বিএনপির ত্রাণ তহবিলে দলের বিপুল নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ ব্যাপক সাড়া দিচ্ছেন। গত পাঁচ দিনে নগদ আড়াই কোটি টাকাসহ প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ত্রাণ সংগ্রহ করে বন্যাকবলিত এলাকায় সরবরাহ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ত্রাণ সহায়তা কেন্দ্রের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ১০ দিন ধরে ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন।
তিনি বলেন, বন্যা-পরবর্তী রোগ-বালাই দেখা দেয়। সেজন্য আমাদের চিকিৎসকরা এবং বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ওইসব এলাকায় ওষুধ বিতরণ করছে। জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন ও ড্যাবের চিকিৎসকরা ওষুধ ক্রয় করে সরবরাহ করছেন। ডা. জাহিদ বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সার্বক্ষণিক ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম তদারকি করছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা, দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারা বন্যাদুর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ সরবরাহ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।
জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) কুমিল্লায় বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করবেন। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ জনি, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টনসহ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা লাগাতারভাবে ত্রাণ বিতরণ করছেন।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, তিনি কয়েকদিন ধরে লক্ষ্মীপুরের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দুর্দশা দেখেছেন। মানুষের করুণ পরিস্থিতি। পানিতে ভিজে অসংখ্য পরিবারে তিনি ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন। মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, তিনি নিজে কোমরপানিতে নেমে ফেনীর বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় গিয়ে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। সরকারিভাবে আরও ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নৈরাজ্য প্রতিরোধ:
সব ধরনের নৈরাজ্য প্রতিরোধ ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মনোযোগী বিএনপি। দলটির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার প্রেতাত্মা এবং দোসররা চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। তারা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নাম ভাঙিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে দখল, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য করছে। আমরা আবারও বলছি, কোনো দখলদার, চাঁদাবাজদের স্থান বিএনপিতে নেই। তারা বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের কেউ নন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর। দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ দখল-চাঁদাবাজি করলে, তাকে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করুন।
নির্বাচনী প্রস্তুতি:
গত বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও শুরু করেছেন তারেক রহমান। তিনি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের স্থিতিশলীতা বজায় রেখে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এদিকে জানা গেছে, সরকারকে আরও কিছুটা সময় দিতে রাজী বিএনপি। এটাকে কৌশল হিসেবেই নিয়েছে দলটি। দলটির একাধিক নেতা জানান, গত ১৫ বছরে বিএনপির উপর যে স্ট্রীমরোলার আওয়ামী লীগ সরকার চালিয়েছে, তাতে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশিরভাগ নেতাকর্মী জেলে ও মামলার ভয়ে ফেরারী থাকায় এলাকায় দলের নেতাকর্মীরা খুব বেশি সময় দিতে পারেননি। তিই নির্বাচনের আগে কিছুটা সময় নিয়ে তৃণমূলে দলকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে চান তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান, এদেশের জনগণের অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) হলো রাজনৈতিক দলগুলো। যদি গণতন্ত্র চান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলুন। সংসদে অতীতে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলাপ করুন। তাদের কাছ থেকে সুপারিশ গ্রহণ ও দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। আমরা গণতন্ত্র ও জনগণের শাসন চাই। প্রতিবেশী দেশের কিংবা অন্য কোনো শক্তির শাসন চাই না।
