
বঙ্গভবন থেকে সরানো হয়েছে মুজিবের ছবি। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি বঙ্গভবনের দরবার হলসহ অনেকগুলো দপ্তর থেকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অপসারণ করা হয়েছে। ছবি সরানোকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও দেখা গেছে বিভিন্ন আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক।
গত সোমবার (১১ নভেম্বর) ভোরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, শেখ মুজিবের ছবি ‘পিছনে টানিয়ে শপথ পাঠ’ এর সমালোচনা করে ফেসবুক পোস্ট দেন।
ওইদিন দুপুরেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সামাজিক মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনের দরবার হলে তোলা তার একটি ছবি পোস্ট করে মুজিবের ছবি সরিয়ে ফেলার কথা জানান।
ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘দরবার হল থেকে ৭১-পরবর্তী ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো হয়েছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার যে আমরা ৫ অগাস্টের পর বঙ্গভবন থেকে তার ছবি সরাতে পারিনি। ক্ষমাপ্রার্থী।’
এরপর সচিবালয়ের বাণিজ্য, নৌ পরিবহন ও স্থানীয় সরকারের মতো কয়েকটি দপ্তর থেকেও ছবি অপসারণের খবর দেখা গেছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কক্ষে এর আগে থেকেই শেখ মুজিবের ছবি ছিল না বলে নিশ্চিত করেছেন জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সাল হাসান।
এসব ঘটনার মধ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একটি মন্তব্য নতুন করে আলোচনার খোরাক জোগায়।
বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি সরানো নিয়ে মন্তব্য করার কয়েক ঘণ্টার মাথায় দুঃখ প্রকাশ করে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন রিজভী।
প্রথমে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি সরানো উচিত হয়নি।’
পরে, ‘যেখানে সব রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে সেখান থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে’ ভেবেছিলেন উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে শেখ মুজিবের ছবি রাখার বাধ্যতামূলক আইন করা হয়েছে।
ফ্যাসিবাদী আইনের কোনো কার্যকারিতা থাকতে পারে না। অফিস-আদালত সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিৎ নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের জন্য আমি দুঃখিত।’
২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় ‘জাতির জনকের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন আইন’ করে আওয়ামী লীগ। ২০০২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেই আইন রহিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পরের মেয়াদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘জাতির পিতার প্রতিকৃতি’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়।
অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সকল সরকারী ও আধা-সরকারী অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’
পরবর্তী সময়ে উল্লিখিত সকল প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা যেত। সঙ্গে দেখা যেত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। ২০১৯ সালে একটি রিটের শুনানি শেষে আদালত কক্ষেও ‘জাতির জনকের’ ছবি টাঙানোর আদেশ জারি করে হাইকোর্ট।
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘জাতির পিতা’ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম বলে মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, ‘আরও অনেক দেশে জাতির পিতা আছেন। তবে সেটি একটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি। কেউ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি। সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে জাতির পিতার অনুচ্ছেদ যোগ করা আওয়ামী লীগ থেকে হাসিনা লীগ হয়ে যাওয়ার আরেকটা বহিঃপ্রকাশ।’
তবে, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দপ্তর বা আদালত থেকে সেসব ছবি অপসারণ করা শুরু হয়।
মাঠ পর্যায়ে সরকারি ও সায়ত্ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেগুলোতে আর শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নেই।
অনেক জায়গায় অগাস্টের পাঁচ তারিখের পরপরই তার এবং শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এদিকে, বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে ছবি অপসারণের পরদিন আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল পেজে একটি প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করা হয়।
তাতে বলা হয়, ‘সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা যে সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করেছে সেই সংবিধানে ৪(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি... সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
‘বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কার্যালয় থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে এই সরকার ও তার উপদেষ্টারা শপথ ভঙ্গ করেছেন,’ বলে দাবি করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ‘একাত্তর পরবর্তী’ সময়কার শেখ মুজিবকে ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং শেখ হাসিনার আমলে স্থাপিত তার ছবি বা ভাস্কর্যকে ‘ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতীক’ হিসেবে দেখেন। তাই, সেগুলো অপসারণের ব্যাপারে সোচ্চার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ‘অ্যান্টি আওয়ামী লীগ’ শক্তির বিজয় হয়েছে।
‘তারা তো তাকে জাতির পিতা হিসেবে মানতে রাজি নয়। এটা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সাথে যায় না,’ যোগ করেন তিনি।
রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক আহমেদ।
তার মতে, ‘পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গত কয়েক দশকে ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। আর সেটির ভোগান্তি সাধারণ মানুষ ভোগ করতেই থাকবে।’
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, বঙ্গভবনের ছবি ওঠানো-নামানো মন্ত্রীর (উপদেষ্টা) কাজ কি না।
‘কোনো উপদেষ্টা বঙ্গভবন থেকে ছবি সরানোর জন্য অথোরাইজড্ নন,’ বলেন তিনি।
যোগ করেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সংবিধানে আছে ততক্ষণ তার ছবি থাকা উচিত।’
‘সংবিধানে থাক আর না থাক’, ‘জাতির পিতা’ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রাখা উচিত বলে মনে করেন পান্না।
যদিও, ‘শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলে মনে করে না অন্তবর্তী সরকার,’ এমন কথা আরও আগেই জানিয়ে দিয়েছেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
সংবিধান সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্লেষকদের ধারণা সংস্কারের ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।-বিবিসি বাংলা