পাসপোর্ট বাতিলের পরও যে উপায়ে ভারতে থাকছেন শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:১২

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত
গত ৮ জানুয়ারি ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাসপোর্ট বাতিলের ঘোষণা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই ঘোষণার পরই হাসিনার ভারতে থাকার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে ভারত।
ভারতে কোনো উদ্বাস্তু সংক্রান্ত আইন না থাকায় এফআরআরও–র মাধ্যমে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে বসবাসের বৈধতা আইনি দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, তার ভারতে থাকার রেসিডেন্ট পারমিটের মেয়াদ বাড়িয়েছে মোদি সরকার।
তবে পাসপোর্ট বাতিল ঘোষণা করার পর সেই পাসপোর্ট এর ভিত্তিতে কী কোন দেশ রেসিডেন্স পারমিট ইস্যু করতে পারে? সবার মনেই এমন প্রশ্ন। কিন্তু রেসিডেন্ট পারমিট কী? বা এটা পেতে কোন কোন শর্ত লাগে? চলুন জেনে নেয়া যাক—
- কোনো বিদেশি নাগরিক ভারতে ১৮০ দিনের বেশি অবস্থান করতে চাইলে তাকে ভারত সরকারের তরফে রেসিডেন্ট পারমিট প্রদান করা হয়।
- ভারতে প্রবেশের ১৪ দিনের মধ্যেই তাকে এই রেসিডেন্ট পারমিট পাবার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হয়।
- ওই ব্যক্তি যে শহরে অবস্থান করছে (দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই) সেই শহরে অবস্থিত 'ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও)' বরাবর এই আবেদন করতে হয়।
- ভারতের অবস্থানরত সময়ে স্থানীয় বৈধ ফোন নাম্বার ও ইমেল আইডি মারফত নির্দিষ্ট ফরমেটে আবেদন করতে হয়। আবেদনের সময় পাসপোর্ট, ভিসা, নিজের চার কপি পাসপোর্ট ছবি, ভারতের অবস্থানের ঠিকানা সহ যাবতীয় বৈধ নথি জমা দিতে হয়। আবেদনপত্রের সাথে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ফি হিসেবে জমা দিতে হয়।
- রেসিডেন্ট পারমিট এর মেয়াদ বৃদ্ধি করতে গেলে ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই মাস আগে নির্দিষ্ট ফরমেটে আবেদন করতে হয়। সেই সাথে ওই ব্যক্তির ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্যও আবেদন করা আবশ্যক।
- তবে ১৬ বছরের নিচে ভারতে অবস্থানরত কোন বিদেশি নাগরিকদের জন্য রেসিডেন্ট পারমিটের জন্য আবেদন করতে হয় না। এমনকি যে সব নাগরিকের 'ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া'-এর সচিত্র পরিচয়পত্র আছে, তাদেরকেও রেসিডেন্ট পারমিট এর জন্য নাম নিবন্ধন করার কোন প্রয়োজন নেই।
প্রসঙ্গত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতোই ঠিক এভাবেই রেসিডেন্ট পারমিট-এর মেয়াদ বৃদ্ধি করে দিল্লিতে রয়েছেন বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।
নাম গোপন রাখার শর্তে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কূটনীতিক বলেন, পাসপোর্ট বাতিল সাধারণত দুই ভাবে হয়। যেমন, বাংলাদেশ শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল ঘোষণা করেছে। এখন সেই পাসপোর্ট নিয়ে তিনি চাইলেই আর বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবেন না। তিনি বাংলাদেশে থাকলেও এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে অন্য কোন দেশে যেতে পারতেন না। কারণ অবশ্যই এটা যে বাংলাদেশ সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করছে।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু বর্তমানে তিনি যেহেতু দেশের বাইরে সে ক্ষেত্রে তার পাসপোর্ট শুধু বাংলাদেশের জন্যই অগ্রহণযোগ্য। তবে এখন বাংলাদেশের কিছু করার নেই। ভারত বা তৃতীয় কোনো দেশের জন্য তার পাসপোর্ট এখনো বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট হিসেবেই ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্তত আন্তর্জাতিক আইন সেই কথাই বলে। বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়টা খুব ভালোভাবেই জানে। ৫ আগস্টের পর ভারতে আশ্রয় নেয়া এমন অনেকেরই পাসপোর্ট বাংলাদেশ সরকার আগে বাতিল ঘোষণা করেছে। তারপরও সেই পাসপোর্ট ও বৈধ ভিসার মাধ্যমে তারা তৃতীয় দেশে যাতায়াত করেছে।
চাইলেই মেয়াদ শেষের আগে বাংলাদেশ সরকার বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট হিসেবে এই পাসপোর্ট আন্তর্জাতিকভাবে বাতিল ঘোষণা দিতে পারে না। এর জন্য একাধিক ধাপ বাংলাদেশ সরকারকে অতিক্রম করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে পাসপোর্ট বাতিলের সর্বোত্তম দ্বিতীয় এই পদ্ধতিটি বেশ জটিল।
এ ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে পাসপোর্ট বাতিলের ঘোষণা দেয়ার পর নির্দিষ্ট প্রমাণসহ অপরাধীর অপরাধের প্রমাণ দিতে হয় ইন্টারপোলে। ইন্টারপোলের জটিল একাধিক ধাপ সম্পন্ন করতে হয় সংশ্লিষ্ট সরকারকে। এরপর ইন্টারপোল আন্তর্জাতিকভাবে ওই পাসপোর্ট বাতিল ঘোষণা দিয়ে চিঠি দেবে অন্যান্য দেশকে। একমাত্র তারপরেই পাসপোর্ট বাতিলের সব ধাপ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। এই পদ্ধতিটি বেশ সময় সাপেক্ষ। এখন যতক্ষণ না ইন্টারপোল এর নোটিশ আমাদের কাছে আসে আমরা ততক্ষণ এই পাসপোর্টকে বৈধ হিসাবেই বিবেচনা করব।
এর আগে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান বাংলাদেশের অভিবাসন এবং পাসপোর্ট দপ্তরের তরফে শেখ হাসিনার পাসপোর্ট বাতিল করা হচ্ছে। আওয়ামি লীগের শাসনকালে বহু মানুষকে ‘গুম’ করা এবং জুলাই গণআন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল করা হচ্ছে। গুম ও হত্যার সঙ্গে জড়িত ২২ জন এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত ৭৫ জনের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে।
সাউথ ব্লক সূত্রের খবর অনুযায়ী, হাসিনার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেখ হাসিনাসহ বাকি অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। ভারতে এসে হাসিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তাবও দিয়েছে। তবে সবই মৌখিক আবেদন। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য লিখিত বার্তা আসেনি ওপার থেকে। বাংলাদেশের আবেদনের জবাব দিতে আইনি প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখছে সাউথ ব্লক। এর জন্য কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। সেই কারণেই হাসিনার থাকার মেয়াদ বাড়ানো হল।