
বক্তব্য রাখছেন নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান ছিল : ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’। গত বছর জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই স্লোগানটি দেওয়া হয়েছিল : ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ সেই ধারাবাহিকতায় সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি এই স্লোগানটির রূপ দিয়েছে এভাবে : ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প।’
মূলত এই ‘বিকল্প’ শব্দটি জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে সারা দেশের দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতেও দেখা গেছে। তার মূল কারণ, বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের বিকল্পহীনতা চলে আসছে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে বলা হতো, তার কোনো বিকল্প নেই। সেই বিকল্পহীনতার ধারণা থেকেই জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন দেওয়ালচিত্র ও গ্রাফিতিতে বিকল্প শব্দটি ঠাঁই পেয়েছে। সেই বিকল্পের ধারণা থেকেই জাতীয় নাগরিক পার্টি গড়ে তোলা হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রশ্ন হলো, এই দলটি কাদের বিকল্প? আওয়ামী লীগ, না বিএনপির? নাকি তারা দেশে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলেরই বিকল্প?
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা কেবল সামনের কথা বলতে চাই, পেছনের ইতিহাসকে অতিক্রম করে সামনের সম্ভাবনার কথা বলতে চাই। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই আমরা আজকে এখানে উপস্থিত হয়েছি। তুমি কে, আমি কে, বিকল্প বিকল্প, আজকে সেই বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।’
নাহিদ বলেন, ‘আমরা শুধু অতীতের ইতিহাসের গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাই না, বরং সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে চাই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই আমরা একত্রিত হয়েছি। বাংলাদেশে বিভাজনের যে রাজনীতি জনগণ ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রেখেছিল, আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই কাঠামো ভেঙে দিয়েছি। এখন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ঐক্যের জায়গা থেকে নতুন যাত্রা শুরু করেছি।’
তার এই বক্তব্যটি বেশ পরিষ্কার। তারা যদি সত্যিই বিভাজনের রাজনীতির বাইরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে চলার রাজনীতি করতে পারেন, সেটি খুবই প্রশংসনীয় ব্যাপার হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দলের নেতারা গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং সংবিধান নিয়ে যে ভাষায় কথা বলেছেন; তাতে বিভাজনের রাজনীতির বাইরে গিয়ে ঐক্যের রাজনীতি করা কতটা সম্ভব হবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন।
জাতীয় নাগরিক পার্টি যেহেতু গড়ে উঠেছে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের নিয়ে এবং যে তরুণদের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, অতএব এই দলটি প্রথমত আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারে। তারা বলেছে, তারা কট্টরপন্থি দল হবে না; বরং মধ্যপন্থি দল। আওয়ামী লীগও যেহেতু মধ্যপন্থি দল, অতএব তাদের বিকল্প হিসেবে নিজেদের তৈরি করার পথে জাতীয় নাগরিক পার্টি হাঁটতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অতীতের তুলনামূলক ভালো নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে আওয়ামী লীগের ভোটার ৩০ শতাংশের বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা ঘটনায় যদি আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কমেও থাকে, তার পরও তার ভোট ২০ শতাংশের নিচে নেমেছে বলে মনে হয় না। আর যেহেতু এই দলের নেতাদের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, ফলে আওয়ামী লীগের ডেডিকেটেড ভোটাররা এই দলকে ভোট দেবে না, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে বিএনপির ভোট ৩০ শতাংশ বা তার কিছু কমবেশি। এই ভোটাররাও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে ভোট দেবে বলে মনে হয় না। এর বাইরে বাকি ৫০ শতাংশ ভোটে জামায়াত, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের হিস্যা রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি কি এসব দলের ভোটে ভাগ বসাবে, নাকি সব দলের ভোটই তারা কমবেশি পাবে?
ভোটের এই হিসাবটা অবশ্য বেশ পুরোনো। কেননা গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে একতরফা। ফলে আসলেই এ মুহূর্তে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও অন্যান্য দলের ভোটের অনুপাত কেমন, সেটি জানা মুশকিল, যতক্ষণ না একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টি জামায়াতের বিকল্প হতে পারে কি না, সেই আলোচনাও রাজনীতির মাঠে আছে। কেননা তারা জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তরুণদের বিরাট সমর্থন তাদের পক্ষে রয়েছে এবং মাদরাসাকেন্দ্রিক বিরাট ভোট ব্যাংক তাদের রয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে জামায়াত যেসব পকেটকে তাদের ভোট ব্যাংক মনে করে, সেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টির হানা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। পক্ষান্তরে এও ঠিক যে, নানা ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির হয়তো আদর্শিক মিল পাওয়া যাবে। ফলে তারা যদি জামায়াতের বিকল্প হয়ে ওঠে, সেটি উভয় দলের জন্যই ক্ষতিকর। সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে এই দুটি দল একটি জোটের অধীনে থাকতে পারে, এমন কথাও শোনা যায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টি কি বিএনপির বিকল্প হবে? মনে রাখা দরকার, বিএনপি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দল এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। এমনকি জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নির্বাচনের যে ঘোষণা দিয়েছে, বিএনপির পক্ষ থেকে তার কড়া সমালোচনা এসেছে। ফলে জাতীয় নাগরিক পার্টি হয়তো চাইবে বিএনপির বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে।
যেকোনো নতুন দলের পক্ষে জনমানুষের মন জয় করে নেওয়া খুব সহজ নয়। যে বাস্তবতা ও পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গঠনের পরপরই ক্ষমতায় চলে এসেছিল, সেই বাস্তবতা এখন আছে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। তবে এটা ঠিক যে, দেশের অনেক মানুষই মনে করে, বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির শাসন তারা দেখেছে, সামরিক শাসন দেখেছে, সেনা নিয়ন্ত্রিত সুশীল শাসনও দেখেছে। সুতরাং এবার নতুন কিছু হোক।
এই নতুন কিছু হোক বলা মানুষের সংখ্যা যদি জাতীয় নাগরিক পার্টি বাড়াতে পারে; তাদের কর্মসূচির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করতে পারে; বাঙালির আবেগ-অনুভূতি এবং ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি না করে এবং যদি তারা সত্যিই বিভাজনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য গড়ে তোলার বার্তাটি পরিষ্কার করতে পারে, তাহলে হয়তো তাদের স্লোগান তুমি কে আমি কে বিকল্প বিকল্প, একদিন সত্যিই বাস্তবে রূপ লাভ করবে।