দেশে ‘শরিয়া আইন’ ও ‘ইসলাম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ড’ চান মামুনুল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১৪:৩০

মামুনুল হক। ফাইল ছবি
আওয়ামী লীগের শাসন আমলে দীর্ঘ ‘দমন পীড়নের’ পর বাংলাদেশের ইসলামীপন্থীরা ফের রাজনৈতিক মঞ্চে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা চাইছে- দেশে ইসলামী শরিয়া কায়েম করতে, ইসলাম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের আইন করতে এবং সরকার মনোনীত নারী কমিশনকে বাতিল করতে। আর এসব বাস্তবায়নের জন্য তারা আসন্ন নির্বাচনকেই সুযোগ হিসেবে দেখছে।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক বলেন, “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, পরবর্তী নির্বাচনে আমরা সংসদে প্রবেশ করতে পারব।”
মাদ্রাসাভিত্তিক প্রভাবশালী ইসলামি দল হেফাজতে ইসলাম শনিবার রাজধানী ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করছে, যা দলটির সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় শক্তি প্রদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে হাজার হাজার হেফাজত সমর্থক ঢাকায় জড়ো হয়েছেন।
এএফপিতে শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্মীয় আবেগ ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে জনগণের মধ্যে নতুন করে ইসলামী চিন্তাভাবনার প্রসারে এই সমাবেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
৫২ বছর বয়সী মামুনুল হকও এএফপিকে বলেন, “তারা দেশে শরিয়া বা ইসলামি আইন বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবেন।”
তার দাবি, তাদের মাদ্রাসা নেটওয়ার্কে প্রায় পাঁচ লাখ সদস্য রয়েছে, যদি ভোট ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হয়- তাহলে নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের ভালো ফল অর্জন সম্ভব।
হেফাজতে ইসলাম একটি ইসলামী দলীয় জোট, যার মধ্যে রয়েছে খেলাফতে মজলিসসহ একাধিক সংগঠন। ১৫ বছর আগে গঠিত এই জোটটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল তাদের সমর্থন পেতে চেয়েছে।
নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ এখনও ঘোষিত না হলেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
দেশে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তখন মূল বিরোধী দলগুলোর অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে নির্বাচনে বিরোধীরা দমন-পীড়নের প্রতিবাদে ও তত্তাবধায়ক সরকারের দাবিতে ভোট বর্জন করেছিল।
হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তার শাসনামলে হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হন। যার মধ্যে ছিলেন মামুনুল হকও। ২০২১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিন বছর তিনি কারাগারে ছিলেন।
২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় বিক্ষোভ করায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা হয়।
আবার একই সঙ্গে ‘দাওরায় হাদিস’কে মাস্টার্স সমমান করায়- হেফাজতে ইসলামের একাংশই শেখ হাসিনাকে কওমি জননী খেতাব দিয়েছিল।
গত আগস্টে রাজধানীতে উত্তাল জনতার একটি দল শেখ হাসিনার বাসভবনে হামলা চালালে তিনি পালিয়ে ভারতের নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেন। তিনি এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেক বাংলাদেশি চায়, তিনি দেশে ফিরে গণবিচারের মুখোমুখি হন।
এএফপি বলছে, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ইসলামী দলগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এ প্রবণতা সমাজের ছোট-বড় নানা অংশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে—বিশেষ করে সুফি মুসলমান ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের মধ্যে। যারা দেশের মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশেরও কম। নারীরাও উদ্বিগ্ন।
ইসলামপন্থিরা যেসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে ‘ইসলামবিরোধী’ মনে করে। তারা সেগুলো বন্ধের দাবি তুলেছে। যেমন সংগীত উৎসব, নাট্যোৎসব, নারীদের ফুটবল ম্যাচ, ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। এরই মধ্যে বহু মাজার ও সুফি দরগায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
এএফপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হকের দল খেলাফতে মজলিসের সমর্থকেরা গত মাসে একটি পাবলিক লাইব্রেরিতে হামলা চালিয়ে শত শত বই নিয়ে যায়। পরে তা ফেরত দেওয়া হয়। দলের যুব শাখার নেতা গোলাম রাব্বানী জানান, তারা শুধু সেসব বইই সরিয়েছেন, যেগুলো তাদের দৃষ্টিতে ‘নাস্তিকতা উসকে দেয়’। তাদের টার্গেট করা বইয়ের লেখকদের মধ্যে ছিলেন নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
হেফাজতের শনিবারের মহাসমাবেশের আগে রাজধানীতে কয়েকটি বড় দলের পক্ষ থেকেও মিছিল হয়েছে, যারা ইসলামী ভোটব্যাংকের সমর্থন চায়।
এই দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—যেটি গঠিত হয়েছে হাসিনাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এবং দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামি।
মামুনুল হক জানিয়েছেন, তারা সরকার মনোনিত নারী কমিশনের আনা প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। যেগুলোতে নারী ও পুরুষের সমান উত্তরাধিকার অধিকারের কথা বলে। তিনি বলেন, “এই কমিশন ইসলামী পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান দেখাচ্ছে। তারা চায়, বিবাহ ও তালাকের ধর্মীয় মূল্যবোধ ভেঙে দিয়ে এখানে একটি পাশ্চাত্য ধাঁচের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে।”
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সংবিধান চারটি মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে মামুনুল হকের বক্তব্য অনুযায়ী, তার দল শরিয়া বাস্তবায়ন চায়। তিনি বলেন, “সবকিছু কোরআনের আলোকে পরিচালিত হবে... একটি ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্রে যারাই হোক- ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ন্যায়সঙ্গতভাবে দেখা হবে।”
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অবমাননার জন্য তারা মৃত্যুদণ্ড চান। মামুনুল বলেন,“আল্লাহর বিরুদ্ধে কথা বললে, নবীর সম্মান ক্ষুণ্ণ করলে এবং মুসলমানদের আহত করলে আমরা মৃত্যুদণ্ড দাবি করি। এই বিষয়ে কোনো আপসের সুযোগ নেই।”