বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানোর পরিকল্পনা চলছে: হেফাজত আমির

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১৫:০২

মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশকে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র বানানোর পরিকল্পনা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।
শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত মহাসমাবেশে সংগঠনটির আমিরের লিখিত বক্তব্য এ কথা জানানো হয়। হেফাজত আমিরের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
হেফাজত আমির বলেন, “সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বার্থে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশকে নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র বানাতে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে।”
গৃহযুদ্ধে জর্জর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পাঠাতে ‘মানবিক করিডোর’ তৈরি করতে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনার পর সরকার ‘নীতিগতভাবে একমত’ বলে সম্প্রতি জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেছিলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) একটা হবে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর মানবিক করিডর ইস্যুটি নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়।
করিডোরের বিষয়ে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাখ্যা দাবি করেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এমন সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। আজ হেফাজতের আমিরের লিখিত বক্তব্যেও মানবিক করিডোর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এজন্য দেশবাসীর জাতীয় ঐক্য আরও দৃঢ় করার আহ্বান জানানো হয়।
মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ‘দেশ এখন বহুমুখী সংকটে। সেইসঙ্গে আগ্রাসী ভারতের ষড়যন্ত্রও থেমে নেই। উপরন্তু, মানবিক করিডোরের নামে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বার্থে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশকে নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র বানাতে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে।
“এমতাবস্থায় আমাদের জাতীয় ঐক্য আরও সুদৃঢ় করতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সংকট মোকাবিলায় আমাদের জুলাই-আগস্টের মতো ইস্পাত-কঠিন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আবারও গড়ে তুলতে হবে।”
জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানের কথা তুলে ধরে হেফাজত আমির বলেন, “৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে জালিম হাসিনা পালিয়ে গেলে আমরা বিজয়ের স্বাদ লাভ করি এবং হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাই। যা অর্জিত হয়েছে সহস্রাধিক প্রাণ ও অকল্পনীয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে।
“স্বাধীনতা আল্লাহর দান। গত পনেরোটি বছর যা থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। তাই মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। ২০১৩ সালে শাপলার গণহত্যা, ২১ সালে মোদীবিরোধী আন্দোলনে শহীদ, পিলখানা ও চব্বিশের জুলাই-আগস্টের সমস্ত শহীদদের মাগফিরাত কামনা করছি।”
দেশে ইসলামবিরোধী গোষ্ঠী আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জানিয়ে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, “সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সাম্রাজ্যবাদের ফান্ডখোর কুখ্যাত নারীবাদীরা এদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, বিধি-বিধান, ঐতিহ্য ও পরিবারকাঠামো ধ্বংস করার পশ্চাত্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে।
“অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, এনজিওবাদী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না, যা কোরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে যায়। এক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দেব না। এই বিতর্কিত কমিশন ও কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার আলেম-ওলামার পরামর্শ নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করুন।”
নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় হেফাজতে ইসলাম কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, দেশের যৌতুকপ্রথা বন্ধে কঠোর আইন করুন। শিক্ষা ও কর্ম ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।”
মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, “গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও সাইবার সিকিউরিটি আইন থেকে ধর্ম অবমাননার শাস্তি সংক্রান্ত ধারাগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে, এটি আরেক গভীর ষড়যন্ত্র।
“সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু— কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারও নেই। তাই ধর্ম অবমাননার শাস্তির আইনি ধারাগুলো বহাল রেখে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ওই নির্দিষ্ট সুপারিশগুলো বাদ দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নামে কটূক্তি বা বিষোদ্গার বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করতে হবে।”
মুক্তমনা চর্চার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “৫ আগস্টের বিজয়কে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে হবে। এমন একটি ন্যায়ভিত্তিক সংবিধান ও সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে এই বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনো কোনো ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের জন্ম না হয়।
“আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। নাস্তিকতা ও মুক্তমনা চর্চার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সংখ্যালঘুদের রাজনীতির বলির পাঁঠা বানানো যাবে না।”
দেশে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এমন একটি বিভেদমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে কাউকে গুম-খুন, জেল-জুলুম ও পুলিশি নির্যাতন করা হবে না। গণহত্যার বিচারের পাশাপাশি ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দালালদেরও বিচার করা হবে। আমরা এদেশে ন্যায়বিচার ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”