নারী কমিশনকে গালি: আইনি নোটিশের পর হেফাজতের দুঃখ প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ১৮:৫০

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদেরকে ‘বেশ্যা কমিশন’ বলে গালাগালে সমালোচনা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির তিন নেত্রীসহ ছয় জনের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশ পাঠানোর পর দুঃখ প্রকাশ করেছে কওমি ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তবে ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে ছাড় না দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
দুই বক্তার অনাকাঙ্ক্ষিত ‘আপত্তিকর’ শব্দচয়নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার কথা জানিয়ে সোমবার সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কোনো আপত্তিকর শব্দ হেফাজত সমর্থন করে না।”
তবে ধর্মীয় ইস্যুতে বাড়াবাড়ি করলে আমরা ছাড় 'দেওয়া হবে না' বলেও হুমকি দিয়ে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে আলেমদের নিয়েও ‘আপত্তিকর’ শব্দচয়নের অভিযোগ এনে সেগুলো থেকেও বিরত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে।
গত শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের সমাবেশটি হয় মূলত ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনাপ্রবাহের পর মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে। তবে বক্তব্যে প্রাধান্য পায় নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়টি।
অন্তর্বর্তী সরকারের করা এই কমিশন উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের সুপারিশ করেছে, সব ধর্মের মানুষদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন করতে বলেছে, আবার যৌনকর্মীদের পেশাকে শ্রম আইনে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
হেফাজতের সমাবেশে এসব সুপারিশকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের চেষ্টা হলে ‘যুদ্ধের’ ডাক দেওয়া হবে।
একজন বক্তা নারী সংস্কার কমিশনকে 'বেশ্যা কমিশন’ আখ্যা দেন। অন্য আরও বক্তাও কটূক্তি করেন।
দুইদিন পর নারীকে জনসভায় অবমাননার অভিযোগে হেফাজতকে আইনি নোটিশ পাঠান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তিন নেত্রী ও তিন জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
নোটিশদাতারা হলেন- এনসিপি নেত্রী সৈয়দা নীলিমা দোলা, দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী ও নীলা আফরোজ এবং সাংস্কৃতিক কর্মী উম্মে রায়হানা, উম্মে ফারহানা ও ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া।
বিবৃতিতে নোটিশদাতার বলেন, “নারী সংস্কার কমিশনকে কেন্দ্র করে কেউ দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন, কিন্তু জনসমাবেশে নারীদের ‘বেশ্যা’ বলা নারীর মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এটা নারীর অধিকার ও লড়াইয়ের প্রতি অবমাননা। আমাদের অবস্থান এর ঘোর বিরোধী।”
এরপরই হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে বিবৃতি আসে। এতে বলা হয়, হেফাজতে ইসলাম নারীর প্রতি আপত্তিকর শব্দচয়ন সমর্থন করেন না।
সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক আফসার মাহমুদের গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে লেখা হয়, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, “আমাদের মহাসমাবেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুজন বক্তা আপত্তিকর শব্দচয়ন করেছেন, যা আমরা সমর্থন করি না। কেউ এতে আহত হলে তাদের প্রতিও আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করছি।”
কমিশন সদস্যদের ‘এনজিওবাদ’, ‘উগ্র নারীবাদী’ আখ্যা
‘নারীর প্রতি ঘৃণার প্রশ্নই আসে না’ মন্তব্য করেও বিবৃতিতে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের বিষয়ে এনজিওবাজ, ‘উগ্র নারীবাদী’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে হেফাজতের অবস্থান তুলে ধরে এতে বলা হয়, “মতাদর্শিক লড়াইকে ‘নারীর প্রতি ঘৃণা’ আকারে দেখাটা স্রেফ মূর্খতা।”
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হেফাজতে ইসলামকে ক্ষুব্ধ করেছে। কমিশনের সদস্যদেরকে তারা নানা সমালোচনায় বিদ্ধ করছে।
যার যার ধর্মীয় বিধান অনুসারে নারীর ‘ন্যায্য অধিকার’ রক্ষায় সংস্কারকাজে সম্পৃক্ত হতে হেফাজতও আগ্রহী জানিয়ে বলা হয়, “কিন্তু শুরুতেই আলেম-ওলামা ও অন্যান্য ধর্মীয় বিশেষজ্ঞকে বাদ দিয়ে একদল ‘এনজিওবাজ নারীবাদীকে’ নিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো।”
কমিশনের প্রতিবেদনকে ‘একচেটিয়া’ দাবি করে বলা হয়, “সেখানে সেক্যুলার প্রগতিশীল নারীসমাজের স্বার্থ ও মতাদর্শ রক্ষিত হলেও ‘ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারীসমাজের’ ধর্মীয় চিন্তা ও বিবেচনা উপেক্ষিত হয়েছে। এই বৈষম্য মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। "
হেফাজত বলেছে, “আমাদের এই সামাজিক ভূমিকা ও ধর্মীয় অবস্থান আধুনিক ব্যবস্থায় এদেশের নারীকে ‘পণ্য’ বানানোর পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নের অন্তরায় বলেই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী আমাদের বিরুদ্ধে একদল ‘উগ্র নারীবাদীকে’ লেলিয়ে দিয়েছে বলে আমরা মনে করি।”
সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের অভিযোগ
বিবৃতিতে হেফাজত দাবি করেছে, আলেম ওলামারা বিদ্বেষের শিকার।
এতে বলা হয়, " সেক্যুলার প্রগতিশীল ঘরানার যারা এতকাল আলেম-ওলামাকে বিদ্বেষমূলকভাবে ‘জঙ্গি’, ‘মৌলবাদী’, ‘ধর্মব্যবসায়ী’ ও ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে কটাক্ষ করে এসেছেন, তাদেরকেও আমরা এ ধরনের আপত্তিকর শব্দচয়ন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।”
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ‘গণহত্যা’ হয়েছে দাবি করে সে সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিস্ট শক্তি’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, “(তাদেরকে) কারা উৎসাহ দিয়েছিল তা আমরা ভুলে যাইনি।"
নারী শিক্ষায় অবদানের দাবি
‘উগ্র ইসলামবিদ্বেষী’ ‘নারীবিদ্বেষী’ অপবাদ দেওয়ার অপরাজনীতি করছে বলে অভিযোগ করে বিবৃতিতে দেশে নারী শিক্ষা বিস্তারে কওমি মাদ্রাসার অবদান রাখার দাবিও করা হয়।
“দেশজুড়ে আমাদের মহিলা কওমি মাদ্রাসাগুলোতে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি বরাদ্দমুক্ত এসব মাদরাসায় সমাজের হাজার হাজার প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের জন্যও বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে এদেশের নারীদের স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে আমাদেরও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে”, বলা হয় এতে।
“ধর্মীয় ইস্যুতে বাড়াবাড়ি করলে আমরা ছাড় দেবো না", লেখা হয় হেফাজতের বিবৃতিতে।