রাজনৈতিক দলের বিচার: ছয় মাস আগে ‘না’, এখন সরকারের ‘হ্যাঁ’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ১৫:৪৭

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছাড়াও দলের শীর্ষ নেতাদের অনেককেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদেরকে প্রায়েই হাজির করা হয় সেখানে। ছবিতে আমির হোসেন আমুকে নেওয়া হচ্ছে ট্রাইব্যুনালে।
ছয় মাস আগে ‘না’ করলেও, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপির কর্মসূচি ও চাপের মুখে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আইন সংশোধন করেছে।
এই সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলকে সাজা ও নিষিদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে করা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
শনিবার রাতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে।
শনিবার রাতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এই প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়।
সংশোধনীতে নতুন বিধান
এতে বলা হয়েছে, “এই আইনের বা তৎকালীন প্রযোজ্য অন্য কোনো আইনের যাই থাকুক না, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এই আইনের ৩ ধারার উপধারা (২) অনুযায়ী উল্লিখিত অপরাধসমূহ করেছে, নির্দেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, প্ররোচিত করেছে, উসকানি দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহজতর করেছে বা সহযোগিতা করেছে, তাহলে ট্রাইব্যুনাল সেই সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করা, তার নিবন্ধন বা লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করার এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখবে।”

সংজ্ঞা ও অপরাধের বিবরণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর ৩ ধারার উপধারা-২ এ যুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধের বিচারের কথা উল্লেখ আছে।
এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে গণহত্যা, যার সংজ্ঞায় বলা আছে, “কোনো জাতীয়, জাতিগত, ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হত্যা বা নির্যাতন ইত্যাদি।”
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যার উদাহরণ হিসেবে বলা আছে, “হত্যা, নির্মূল, দাসত্ব, দেশান্তর, নির্যাতন, ধর্ষণ বা অন্য কোনো অমানবিক কাজ — যদি তা বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।”
যুদ্ধাপরাধ, যার ব্যাখ্যায় বলা আছে, “যুদ্ধবিধি লঙ্ঘন করে হত্যা, নির্যাতন, যুদ্ধবন্দিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, লুটপাট, ধ্বংস, জোরপূর্বক শ্রম ইত্যাদি।”
শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, যার সংজ্ঞায় বলা আছে “আগ্রাসনমূলক যুদ্ধ শুরু করা বা যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করা।”
এবং
অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, সহায়তা বা উসকানি দেওয়া, যার সংজ্ঞায় বলা আছে, “যারা সরাসরি অপরাধ না করলেও পরিকল্পনা করেছে, সহায়তা করেছে বা উসকানি দিয়েছে, তাদেরও এই আইনের আওতায় বিচার করা যাবে।”
২০২৪ সালের আন্দোলনের বিচার
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সে সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং সরকারের মন্ত্রীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ঘটনায় আলাদা হত্যা মামলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও আবেদন জমা পড়েছে।

এরই মধ্যে একটি অভিযোগের প্রতিবেদন জমা পড়েছে। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও প্রতিবেদন প্রস্তুত রয়েছে।
তাজুল ইসলাম ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এক দশক আগে জামায়াত নেতাদের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন।
পাল্টে গেল সরকারের অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে প্রাণহানির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করতে একবার আইন সংশোধন করেছে গত নভেম্বরে।
সে সময় আইন সংশোধনের খসড়ায় অপরাধ প্রমাণিত হলে দল ও সংগঠনের ১০ বছর নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়।
তবে ২০ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এটি বাদ রেখে সংশোধনী অনুমোদন করা হয়।
সেদিন রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়, “খসড়ায় সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশের যে বিধান প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা বাদ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।”

উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত জানাতে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “আমরা যে অধ্যাদেশের সংশোধনী করেছিলাম, সেখানে সংগঠনকে শাস্তি দেওয়ার বিধান ছিল। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, কোনো সংগঠনকে শাস্তি দেওয়ার যদি প্রয়োজন মনে করে, যদি মনে করে শাস্তি দেওয়া দরকার, তাহলে ট্রাইব্যুনাল শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করতে পারবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে।”
ছয় মাসের মধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত পাল্টে যায় গত বুধবার রাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের পর উদ্ভূত ঘটনাপ্রবাহে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনায় করা একাধিক মামলার আসামি। ছোট ছেলে ও শ্যালককে নিয়ে তার থাইল্যান্ড যাওয়ার পর এনসিপি নেতারা ক্ষোভ জানাতে থাকে।
দিনভর নানা প্রতিক্রিয়ার পর জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন।
পরের দিন জুমার নামাজের পর সেখানে জমায়েত হয়, সন্ধ্যায় জমায়েতকারীরা শাহবাগ মোড়ে দিয়ে অবস্থান নেয়। শনিবার সেখান থেকে আবার যমুনামুখী মার্চ ঘোষণার মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।

সেই বৈঠকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে সংগঠনের বিচারের সুযোগ রাখা এবং বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠকেই আইনের সংশোধনী অনুমোদন করা হয়।
সরকার প্রধানের দপ্তর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে জানিয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।