
গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিনিয়োগের নামে ‘সার্কাস’ দেখানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এক স্মরণ সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন।
সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি নেতা বলেন, “বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। অথচ গত নয় মাসে বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে কমছে। শুধু ‘বিনিয়োগের সার্কাস’ দেখানো হচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা একটি নির্বাচিত ও স্থিতিশীল সরকার চায় বলে মন্তব্য করে খসরু বলেন, “বিদেশিরা এখনও শেষ প্রশ্নটা করেন, ‘নির্বাচন কবে?’।”
বিএনপি নেতা বলেন, “শেখ হাসিনা বলতেন, ‘আমরা উন্নয়নের শিখরে যাচ্ছি, নির্বাচন দরকার নেই’, এখন বর্তমান সরকারও বলছে মানবাধিকার গুরুত্বপূর্ণ না। এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার, কারও মুখ দেখে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না।”
গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ঢাকায় ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট’ নামে একটি বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এই আয়োজন নিয়ে সরকারের তরফে বেশ উচ্ছ্বাস ছিল। বলা হচ্ছিল, এই সম্মেলনে দেশ বিদেশের শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসবেন; এই বিনিয়োগের কারণে দেশে চাকরির বন্যা বয়ে যাবে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তবে সম্মেলনে সুনির্দিষ্ট বড় কোনো ঘোষণা পাওয়া যায়নি।
এই সম্মেলন থেকে খুব বড় ঘোষণা এসেছে তা নয়, চীনা প্রতিষ্ঠান হান্ডা ও দেশি কোম্পানি শপআপ ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। এর বাইরে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে ছয়টি।
তবে বাণিজ্য বিষয়ক দৈনিক বণিক বার্তা মঙ্গলবার ‘বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান উড়ছেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমছে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে, তাতে দেখা যাচ্ছে দেশে বিনিয়োগ আসল কমছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ ছিল ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উইকলি সিলেকটেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরসের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়, “চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে মূলধনি যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি বা আমদানি বাবদ অর্থ পরিশোধ হয়েছে ১৫২ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল ২১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ মূলধনি যন্ত্র আমদানি কমেছে ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।”
বাংলাদেশকে ষড়যন্ত্রে জড়ানোর অভিযোগ
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে জড়ানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, “মানবিক করিডোরের বিষয়ে কার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে? একটি অনির্বাচিত সরকার এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অথচ দেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল কেউ কিছু জানে না।”
এটা কার এজেন্ডা? — সেই প্রশ্ন তুলে আমির খসরু বলেন.সেই প্রশ্ন তুলে আমির খসরু বলেন, “কাদের স্বার্থে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা হচ্ছে? এমনকি নির্বাচিত সরকার হলেও এমন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন।
“একটি ছোট গোষ্ঠী যদি মনে করে, তারা তাদের স্বার্থে পুরো জাতিকে জিম্মি করতে পারবে, তাহলে তারা ভুল করছে। জাতি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।”
সংস্কারের নামে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার চক্রান্ত
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, তাকে ‘কথিত’ উল্লেখ করে আমির খসরু অভিযোগ করেন, “জনগণকে বাদ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার চক্রান্ত চলছে।”
নির্বাচনহীন সরকারের হাতে কোনো সংস্কার গ্রহণযোগ্য নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বর্তমান সরকারের কার্যক্রম বিগত দিনের মতই চালু হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, “সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। অথচ বিএনপিই সবার আগে ‘হাসিনা পরবর্তী’ সময়কে মাথায় রেখে সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছে। এখন যারা সংস্কারের কথা বলছে, আন্দোলনের সময় তাদের কোথাও দেখা যায়নি।
“তারা এখন আমাদের সংস্কারের তালিম দিচ্ছে। অথচ আমরা ইতোমধ্যেই ৩১ দফা সংস্কারের প্রস্তাব জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছি। যাই বলেন, দিন শেষে সবকিছুই হতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যম।”
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর সরকার গঠন করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কারের কথা সামনে আনেন। এ লক্ষ্যে ১০টিরও বেশি কমিশন গঠন করা হয়েছে, কমিশনগুলোর বেশিরভাগই এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এই কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি।
আমির খসরু বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেসব সংস্কার দ্রুত কার্যকর করা উচিত। কিন্তু জনগণ কেন জানতে পারছে না— কোথায় ঐকমত্য হয়েছে? সব রাজনৈতিক দলই তাদের মতামত দিয়েছে, তাহলে দেরি কেন?”
বিএনপি নেতা বলেন, “আমরা কাউকে মালিক বানাইনি যে তারা নিজেদের মতো সংস্কার করবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেসব বিষয়ে দলগুলো জনগণের কাছে যাবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তারা সংসদে যাবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
“কেউ যদি মনে করে শেখ হাসিনার মালিকানা এখন তাদের হাতে, তাহলে তারা ভুল করছে।”
শেখ হাসিনা ‘ছোট ছোট স্বৈরাচার’ রেখে গেছেন বলে মন্তব্য করে বিএনপি নেতা বলেন, “তার সেই লক্ষণ এখন আমাদের কথাবার্তা ও আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য আপনি জনগণকে বাইরে রেখে সংস্কারের কথা বলবেন, এটা হবে না।”
নির্বাচন দাবি
জনগণকে ‘বাইরে রেখে’ সংস্কার চলতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন আমির খসরু। তিনি বলেন, “দেশের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতেই হবে।
নির্বাচনের কোনো লক্ষণ না দেখে হতাশাও প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, “দেশের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার একমাত্র পথ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অর্ডার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সে প্রক্রিয়ার সূচনা এখনও হয়নি।”
ভাসানী অনুযায়ী পরিষদের সভাপতি শেখ রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাও বক্তব্য রাখেন।