ড. মুহাম্মদ ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এক সংকটময় পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের আলোচনা সামনে আসায় এ সরকারের ভবিষ্যত নিয়েই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসকে কেন পদত্যাগের চিন্তা করতে হচ্ছে, সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে গঠিত এই সরকারকে কেন এমন সংকটে পড়তে হলো-এসব প্রশ্ন এখন সব মহলে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
এ ঘটনা এমন সময়ে ঘটছে যখন বিএনপি রাজপথে কর্মসূচি রেখেছে এবং এ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন আর অব্যাহত না রাখার ইঙ্গিতও দিচ্ছে।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত বুধবার বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে নির্বাচন, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর প্রসঙ্গ এবং মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিষয়সহ সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। যা সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে।
এমন এক পটভূমিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস গতকাল বৃহস্পতিবার অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে নানা পক্ষের প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতায় তার সরকার কাজ করতে পারছে না বলে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
অধ্যাপক ইউনূসের এমন ভাবনার কথা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। নাহিদ ইসলামের মাধ্যমেই প্রধান উপদেষ্টার এই ভাবনার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতিটাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করছে। বিএনপি বলছে, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ও তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগের তাদের দাবি এড়াতে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনার কথা সামনে আনা হয়েছে।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে আবেগ সৃষ্টি করার কিছু নেই।”
বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা এ-ও বলছেন, সরকারের দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি সামলাতে যখন ব্যর্থতার প্রশ্ন আসছে, তখন পদত্যাগের এই ভাবনার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এক ধরনের হুমকি বা সতর্কতা বলে তারা মনে করছেন।
এখন অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংকট সামলাতে জামায়াতে ইসলামী সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার পরামর্শও দিয়েছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের পক্ষ আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য এখনো দেওয়া হয়নি।
কেন সংকটে সরকার
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সেই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্ব, বিএনপি ও জামায়াতসহ সব দল এবং সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সর্বাত্নক সমর্থন দিয়েছিল।
এতবড় সমর্থন পাওয়ার পরও সেই সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ কেন আসছে, এমন প্রশ্ন তুলছেন রাজনীতিক ও বিশ্লেষকেরা।
তারা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি অধ্যাপক ইউনূসের দুর্বলতা রয়েছে; যা তিনি নিজে বিভিন্ন সময় প্রকাশও করেছেন।
সেই ছাত্র নেতৃত্ব যখন রাজনৈতিক দল এনসিপি গঠন করল, এই দলের প্রতিও তার পক্ষপাতিত্ব রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে। যা বিএনপিকে ক্ষুব্ধ করেছে।
যদিও উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের একজন পদত্যাগ করে দলটির হাল ধরেছেন। কিন্তু আরও দুজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা পদে রয়ে গেছেন। তাদের পদত্যাগের দাবিতে এখন রাজপথে কর্মসূচি রেখেছে বিএনপি।
সরকারের গত নয় মাসে প্রথম দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পরে এনসিপির ব্যানারে বিভিন্ন ইস্যু তুলে রাজপথে অবস্থানসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে।
সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভনের সামনেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে।
বিএনপি বিভিন্ন সময় সরকারের বিরুদ্ধে এনসিপির প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেছে। এথন তারা সেই অভিযোগকে সামনে এনেছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিষয়টি আলোচিত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মব সৃষ্টি করে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দাবি তুলে তা আদায়ের চেষ্টাও করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বা সমর্থনের বিষয়ও বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ যেমন রয়েছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর অস্হযোগিতার বিষয়ও আলোচনায় আসছে।
সরকারের একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা গতকাল তাদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন, সেখানে অধ্যাপক ইউনূস নিজেও অংশীজনদের অসহযোগিতার কথা বলে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্লেষকেরা রাজনীতিতে বিভক্তি, দলগুলোসহ সরকারের অংশীজনদের বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ নিয়ে বিরোধ এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। সেকারণে অসহযোগিতার বিষয় প্রকট হয়েছে।
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি, এই তিনটি দলের এখন প্রভাব রয়েছে। তিনটি দলের মধ্যে সম্পর্ক টানাপোড়েন বেড়েছে। ফলে রাজনীতিতে বিভক্তি দেখা যাচ্ছে।
তিনি মনে করেন, সরকারের দিক থেকেও করিডর ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপিসহ দলগুলো ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। ফলে বিএনপি ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনরা ক্ষুব্ধ হয়েছে।
একইসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি আছে। সবমিলিয়ে সরকার কাজ করতে পারছে না। সে কারণে সরকারের জন্য সংকট গভীর হয়েছে বা সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
সরকারের ভেতর থেকেও করিডরসহ বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু যখন সামনে আনা হচ্ছে, তখন সরকারের ভেতরেও কোনো গোষ্ঠী স্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থ কাজ করছে কিনা- সেই প্রশ্নও রয়েছে বিশ্লেষকদের।