সেনাবাহিনী নিয়ে ‘বিতর্ক’ নয়, করিডোর-বন্দর নিয়ে ভাবুক নির্বাচিত সরকার: জামায়াত

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১৫:৩৯

শনিবার সকালে রাজধানীর বড় মগবাজারে দলীয় মজলিসে শুরার বৈঠকে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান।
কারও কোনো পদক্ষেপে সেনাবাহিনী বিতর্কিত হোক, এটা চান না জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া আর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডোর গঠন বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্বাচিত সরকার নিক, এমনটাও বলেছেন তিনি।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চান বলে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে আসার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জামায়াত আমির এসব কথা বলেন।
শনিবার রাজধানীর বড় মগবাজারে আল ফালাহ মিলনায়তনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার অধিবেশন উদ্বোধন করে দলের এই অবস্থান তুলে ধরেন তিনি।
শফিকুর বলেন, “ইতিহাসের অনেক বাঁকে মর্যাদাপূর্ণ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে। কোনো কার্যক্রমের মাধ্যমে, কারও কোনো পদক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের এই গর্বের প্রতিষ্ঠান বিতর্কিত হোক এটা আমরা চাই না। আমরা চাই এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পূরণ রেখে তার দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকবে।”
সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেখার আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে তথ্য এসেছে। বিএনপিও একটু কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তারা জানিয়ে দিয়েছে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে সরকারকে আর সহযোগিতা করা হবে না।
গত মঙ্গলবারও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পরের দিন অফিসার্স অ্যাড্রেসে তিনি ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
নির্বাচন সেনাপ্রধান ও বিএনপির এমন অবস্থানের মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন বলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানিয়েছেন। এ নিয়ে জোর আলোচনার মধ্যে জামায়াত আমির সেদিনই সরকারকে সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বানের পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে ইউনূস কেন পদত্যাগ করতে চাইছেন, এটা স্পষ্ট নয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আসা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউনূস আক্ষেপ করেছেন যে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা পাচ্ছেন না, বারবার বিরোধিতার মুখে পড়ছেন।
তবে দৃশ্যত গত সাড়ে ৯ মাসে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনগুলো সরকারের উদ্যোগগুলোর মধ্যে করিডোর আর চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কোনো কিছুর বিরোধিতা করেনি। আবার এ বিষয়ে জামায়াতের জোরাল বক্তব্য আসেনি।
সিদ্ধান্ত নিক নির্বাচিত সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডোর গঠনের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান তুলে ধরে শফিকুর বলেন, “এর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত। এ বিষয়টি ভেবেচিন্তে আগাতে হবে, হুট করে কোনো কিছু করা যাবে না।
“এখন দেশে কোনো সংসদ নেই, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উপদেষ্টাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরকারের এ ব্যাপারে সংলাপে বসা উচিত।”
‘সব পক্ষের’ সঙ্গে না বসে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে তা কল্যাণকর হবে না বলেও সতর্ক করেন জামায়াত আমির। তিনি বলেন, “বিষয়টি যেহেতু অনেক বড় সেটাকে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। সেটাই উত্তম হবে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের নেওয়া উচিত বলে মত জানিয়েছে জামায়াত। মিয়ানমারের জন্য মানবিক করিডোর গঠনের প্রশ্নেও একই অবস্থান জানিয়েছে দলটি।
চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াও সরকারের উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেন শফিকুর। তিনি বলেন, “আরও অংশজনের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসা উচিত।”
‘নির্বাচন নিয়ে বাধ্য করতে চাই না’
নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন জাতীয় নির্বাচন তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে করতে চান। আমরা বারবার বলেছি তার এই কথার উপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এছাড়া আমাদের বিবেচনায় নির্বাচনের সময় কী হতে পারে সেটাও আমরা বলেছি। আমরা তাকে বাধ্য করতে চাই না।”
কেন বাধ্য করতে যাবেন নেই প্রশ্ন রেখে শফিকুর বলেন, “কারণ, তিনি (ইউনূস) তো সকলের সমর্থিত। আমরাই তো তাকে এ জায়গায় এনেছি। কিন্তু জোর করে নেননি। তিনি তো আমাদের প্রতিপক্ষ না। ইনি এখন সরকারের অভিভাবক। সকল রাজনৈতিক দল ও অংশীজন স্বেচ্ছায় আমরা তার উপরে সে দায়িত্ব অর্পণ করেছি।"
অর্থবহ সংলাপ প্রয়োজন
জামায়াত আমির বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে দেশে ঘটে যাওয়া অনেকেগুলো ঘটনা, দেশবাসী ও এ দেশের মানুষ যারা প্রবাসে আছেন সবাইকে বিচলিত করে তুলেছে। আমরা বিচলিত না হলেও সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে এই পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী চুপ করে থাকতে পারে না।”
সংঘাত ও কাদা ছোড়াছুড়ি মধ্যে দিয়ে জাতিকে আর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া সমীচীন হবে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এমন পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত। এ জন্য প্রয়োজন অর্থবহ সংলাপের। এ দায়িত্বটা মূলত বর্তমান সরকারকে নিতে হবে এবং তাদেরকেই সংলাপের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
“সমস্যা যত বড়ই হোক আমরা এটা বিশ্বাস করি যে আলোচনার মধ্যে দিয়ে সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছা সম্ভব।”
জামায়াত আমির বলেছেন, তারা চান না প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করুন। যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে সংলাপেই সমাধান সম্ভব, বলছে তারা।
প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজনের আহ্বান আবার তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি সেই বৈঠকে ভালো কিছু বের হয়ে আসবে।”
অতীতেও সংলাপে উদ্যোগও সফল হয়েছে বলে মত দিয়ে শফিকুর বলেন, “আমরা আশাবাদী, আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
নির্বাচন, সংস্কার নিয়ে আলাদা রোডম্যাপ দাবি
নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকারের কাছে তার দল দুটি রোড ম্যাপ প্রত্যাশা করেছিল উল্লেখ করে জামায়াত নেতা বলেন, “আমরা বলেছিলাম সংস্কারের একটা রোড ম্যাপ দেওয়া হোক যে, ‘এই মাসের ভেতরে সংস্কার সম্পন্ন হবে। এরপরেই তার পাশাপাশি নির্বাচনের একটা রোড ম্যাপ দেওয়া হোক। তাহলে জনগণের স্বস্তি এবং আস্থা তৈরি হবে।”
এখন পর্যন্ত দুটি রোড ম্যাপের কোনোটাই জনগণের সামনে আসেনি বলে মন্তব্য করে শফিকুর বলেন, “এখান থেকেও কিছু সন্দেহ সংশয় জন্ম নিয়েছে। সরকারকে অনুরোধ করব যত শীঘ্র সম্ভব এ দুটি রোড ম্যাপ জনগণের সামনে প্রকাশ করা হোক।”
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘গুম, খুনে’ জড়িতদের বিচারের প্রক্রিয়া ‘দৃশ্যমান’ হতে হবে বলেও উল্লেখ করেন জামায়াত নেতা।