
সাতক্ষীরার শ্যামনগরসংলগ্ন পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) রেখে যাওয়া ব্যক্তিরা।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, চোখ ও হাত বেঁধে সীমান্তে এনে লোকজনকে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে (পুশ-ইন) ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। দেশের তিনটি সীমান্ত পথ দিয়ে অর্ধশত লোককে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়। বৈরী আবহাওয়ার সুযোগে বিএসএফ তাদের হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আসে। পরে বাঁধন খুলে তাদের বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশি’ দাবি করে কিছু লোককে আটক করা হয়। পরে তাদের পুশ-ইন করতে থাকে ভারত। ৭ মে প্রথম দফায় খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ৬৬ গত ৭ মে ভোর ৬টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ভাওয়ালকুড়ি সীমান্তবর্তী নতুনহাট বাজার এলাকায় ২২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের টহল দল পুশ-ইনের শিকার পাঁচজনকে আটক করে জানতে পারে যে তারা একই পরিবারের সদস্য এবং ভারতের আসামের মাটিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন। তাদের কাছ থেকে ইউএনএইচসিআর, নয়াদিল্লি কর্তৃক ইস্যুকৃত পাঁচটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড উদ্ধার করা হয়।
সাম্প্রতিক পুশ-ইন শুরু হয়েছে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরপরই, যার সূত্রপাত গত ২২ এপ্রিল ভারতের কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ ভারতীয় নাগরিক নিহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে। ওই ঘটনার পরই ভারতের গুজরাটে অভিযান চালিয়ে ‘অবৈধ ভারতীয় নাগরিক ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে আরো ৩৬ জনকে পুশ-ইন করা হয়। এর পর থেকে পুশ-ইন অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত কত লোককে ভারত ঠেলে দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশি এবং কতজন রোহিঙ্গা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এমনকি ভারতে বহু বছর ধরে বসবাসরত ভারতীয় মুসলিমদেরও অনেককে সম্প্রতি পুশ-ইন করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, ভারতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদেরও পুশ-ইন করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘের নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদেরও ভারত কী করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়? এটা সুস্পষ্টভাবে জাতিসংঘের সঙ্গে ভারতের শর্তের খেলাপ এবং একই সঙ্গে মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।
কিন্তু বাংলাদেশ কি ভারতের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে অবহিত করেছে বা লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছে?
গত ১৫ মে রাত ২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, মে মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত হাজারের বেশি মানুষকে ভারত পুশ-ইন করেছে। এর মধ্যে কতজনকে বাংলাদেশ পুশ ব্যাক করেছে বা করতে পেরেছে, তা নিশ্চিত নয়। যাদের পুশ-ইন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কোনো অপরাধী রয়েছে কি না এবং তারা উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশ মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে বিএসএফ। তবে বিজিবি ও স্থানীয় মানুষের কঠোর প্রতিরোধের মুখে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর গত ৩০ মে রাতে কুড়িগ্রামের কচাকাটা সীমান্তে বিএসএফের পুশ-ইন নিয়ে রাতভর উত্তেজনা চলে।
ভারত থেকে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ-ইনের ঘটনায় এরই মধ্যে দেশটিকে চার দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ৭ মে পুশ-ইন শুরু হওয়ার পরদিন ৮ মে ভারতকে প্রথম চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ১৩, ১৫ ও ২০ মে আরো তিন দফায় চিঠি পাঠানো হয়। এসব চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির নাগরিকত্ব পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কাউকে যেন পুশ-ইন করা না হয়। বাংলাদেশের মূল স্রোতে মিশে গিয়ে কোনো ধরনের নাশকতায় জড়িয়ে যাবে কি না, তারই বা নিশ্চয়তা কী? তার চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো, বাংলাদেশ-ভারত দীর্ঘ সীমান্তের পুরোটাজুড়ে সার্বক্ষণিকভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নিñিদ্র পাহারা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। সীমান্তের অনেক স্পট অরক্ষিত আবার কিছু স্পট দুর্গম। গণমাধ্যমের খবর বলছে, সীমান্তবর্তী ১৭ জেলার ২৬টি স্থান দিয়ে পুশ-ইন হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলার তিন সীমান্ত দিয়ে। বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় থাকায় বিজিবির টহল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ। এই ২৬টি সীমান্ত এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিজিবি। ওই সব এলাকায় টহল জোরদার, সীমান্ত পাহারায় স্থানীয়দের যুক্ত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পাহারা দিয়ে পুশ-ইন ঠেকানো যাচ্ছে না। উপরন্তু এখন বৈরী আবহাওয়ার কারণে রাতের অন্ধকারে সীমান্তের কোন অংশ দিয়ে বিজিবি কত লোককে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় তারও হিসাব রাখা কঠিন।
সব মিলিয়ে ভারত যে পুশ-ইন ইস্যু দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে লালমনিরহাট সীমান্তে দুইশর বেশি মানুষকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করার চেষ্টা করেছিল ভারত। কিন্তু ঢাকার অনমনীয় অবস্থানের কারণে সীমান্তের শূন্যরেখায় তাদের সময় বিজিবি ও আনসার ভিডিপি পুশ-ইন ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে পুশ-ইন ঠেকাতে প্রায় এক কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় মানব দেওয়াল সৃষ্টি করে রাতভর পাহারা দেয় হাজারো স্থানীয় জনতা। রাত ৩টার দিকে শূন্যরেখা থেকে সরে যায় বিএসএফ। যদিও গত ১৭ মে সুন্দরবনের গহিনে শনিবার নতুন একটি ভাসমান সীমান্ত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র-বিওপি উদ্বোধনের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ভারত এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘উসকানি’ দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন না।
প্রশ্ন হলো, ভারত হঠাৎ এই ধরনের তৎপরতা বাড়িয়ে দিল কেন? পুশ-ইন বাড়িয়ে দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশকে এক ধরনের চাপের মধ্যে রাখতে চাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে? ভারত কেন বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়, তারও কারণ অজানা নয়। ‘পুশ-ইন’ ঠেকাতে কূটনৈতিক সমাধানের অংশ হিসেবে ভারতকে চিঠি লেখার কথা জানিয়েছেন উপদেষ্টা। একই সঙ্গে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের দূত, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে বলে জানান থাকতে হয়েছিল প্রায় দুই মাস। তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খান এ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহার সঙ্গে আলোচনার জন্য দিল্লি গিয়েছিলেন। দিল্লির সঙ্গে আলোচনার ঠিক আগেই দেখা যায়, সীমান্তের শূন্যরেখায় প্রায় দুই মাস ধরে থাকা ওই লোকজন আর নেই। তার মানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পুশ-ইন বন্ধ হবে না। ভারত যদি বুঝে ফেলে যে বাংলাদেশ এই ইস্যুতে জোরে কিছু বলবে না বা শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না, তাহলে তারা পুশ-ইন অব্যাহত রাখবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত ২১ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘দিল্লির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আমরা চেষ্টা করছি নিয়মের বাইরে যাতে কিছু না ঘটে।’
এর আগে গত ৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লোকজনকে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের কর্মকাণ্ড যথাযথ চ্যানেলে পরিচালিত হয়নি। তিনি এটিকে একটি ‘অন্যায্য পদ্ধতি’ বলে অভিহিত করেন। তবে এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়, বরং বাংলাদেশকে এখন জোরালো ভাষায় পুশ-ইনের প্রতিবাদ করতে হবে। ভারতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘকে জানাতে হবে এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘের কঠোর পদক্ষেপ চাইতে হবে।
অতীতের মতো ভারত-তোষণ ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে পুশ-ইন ঠেকানো যাবে না। এখানে সরকারকে মেরুদণ্ড সোজা রেখে ভারতীয় শাসকদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং সে কারণে ভারত একটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশের ওপর তার যেকোনো ধরনের খবরদারি বা দাদাগিরির এখতিয়ার নেই, সেটি স্পষ্ট ভাষায় ভারত সরকারকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে পুশ-ইনের মতো এই অন্যায্য তৎপরতা ঠেকাতে বাংলাদেশকে তার বিদেশি অন্য বন্ধুদের যুক্ত করতে হবে। বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলতে হবে। তার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা। দিন শেষে এটা যেহেতু একটা আন্ত রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও মানবিক ইস্যু। অতএব, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। ভারতের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি ও নিশ্চয়তা গ্রহণ করতে হবে যে, আর একজনকেও তারা পুশ-ইন করবে না। যদি ভারত এটা বন্ধ না করে তাহলে বাংলাদেশ কী করবে সেটিও ভারতকে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।