
এক মাস তুমুল আলোচনা আর জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সোমবার মধ্যরাতে দেশে ফেরেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
তার এই থাইল্যান্ড যাত্রার প্রতিক্রিয়ায় এনসিপির কর্মসূচি ঘোষণার দুইদিনের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ। গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দলের বিচারের সুযোগ রেখে সংশোধন হয়েছে আইনও।
পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে শাস্তি পেয়েছেন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। এই বিদেশযাত্রার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও হয়েছে।
বলাবলি হচ্ছিল, সাবেক রাষ্ট্রপতি ‘চুপিসারে পালিয়ে; গেছেন। তবে তার স্বজনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তার এই যাত্রার কারণ চিকিৎসা। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার অংশ হিসেবেই তিনি বিদেশে চিকিৎসার এই সুযোগ পেয়ে থাকেন।
তবে গতরাতে তার ফিরে আসার মধ্য দিয়ে ‘চলে যাওয়ার’ এই আলোচনার অবসান হয়েছে। তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে, তার থাইল্যান্ড যাত্রার পর পুলিশের যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাদের কী হবে।
কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের তরফে কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ৭ মে গভীর রাতে আবদুল হামিদের থাইল্যান্ড যাত্রার পর ভোরে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদনটি আসে।
তাতে কোথাও বলা হয়, তিনি ‘চুপিসারে’ চলে গেছেন, কোথাও বলা হয়, তিনি ‘অনেকটা গোপনে’ গেছেন।
সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই যাত্রায় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক এএম নওশাদ খান।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ
হামিদের বিদেশযাত্রার খবর আসার পর ৮ মে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান।
তার সেই আহ্বানে সাড়া দেয় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেওয়া ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনটি।
একই দিন এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলম অভিযোগ করেন, আবদুল হামিদকে ‘পালাতে’ দেওয়া হয়েছে। তিনি ব্যর্থতার দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেও দেন।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ৮ মে রাতভর যমুনার সামনে এনসিপি ও অন্যদের জমায়েত শেষে পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজের পর হয় সমাবেশ। তীব্র গরমের মধ্যে সেই সমাবেশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারীদের গায়ে ঠান্ডা পানি ছিটানো হয়।
তবে যমুনার আশেপাশে জমায়েত নিষিদ্ধ থাকা নিয়ে আলোচনার মধ্যে আন্দোলনকারীরা পরে অবস্থান নেন শাহবাগে। সেখানে বক্তব্যে বিএনপিকে তুলাধুনা করা হয়, কেন তারা এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি, সেই প্রশ্নও রাখেন এনসিপি নেতা ও অন্যরা।
এর মধ্যে ১০ মে বিকালে ঘোষণা আসে, জরুরি বৈঠক বসতে যাচ্ছে যমুনায়। সেখানে উপস্থিত থাকবেন সব উপদেষ্টা।
বৈঠক শেষে রাতে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।”
এই কর্মসূচিতে যোগ না দিলেও পরে বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান তারা সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারাও সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন
আবদুল হামিদ থাইল্যান্ড যাওয়ার পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণহানির ঘটনায় দলটিরও বিচারের দাবি সামনে আনে এনসিপি। উপদেষ্টা পরিষদের সেই বৈঠকেই এই দাবি পূরণ হয়ে যায়।
সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়। এতে বলা হয়েছে, ট্রাইবুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এর আগে ট্রাইব্যুনালের আইনের যে সংশোধনী এনেছিল সেখানে সংগঠনের বিচারের বিষয়টি ছিল না।
‘গোলাম আযমের বাংলায়’ স্লোগান
শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জমায়েতে বেশ কিছু স্লোগান উঠে, যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক উঠে রাজনীতিতে।
এসব স্লোগানের মধ্যে ছিল, ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’, ‘নব্য রাজাকার শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ ছাড়ো’, ‘জয় বাংলা নয়, ন্যায্য বেতন চাই’, ‘শাহবাগ মুক্ত কর, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ কর’ এবং ‘আল্লাহর জমিনে নাস্তিকের ঠাঁই নাই’।
এমনকি জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় এক পক্ষ বলেছিল, ‘এইটা আমাদের গান না, বন্ধ করো।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নেওয়া নেতার পক্ষে এই স্লোগানের মধ্যে ১২ মে এনসিপি এর দায় অস্বীকার করে বিবৃতি দেয়।
এতে লেখা হয়, “আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি জাতীয় নাগরিক পার্টি – এনসিপির কোনো সদস্য সাম্প্রতিক আন্দোলনে দলীয় স্লোগান কিংবা এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাসবিরোধী কোনো স্লোগান দেয়নি।
“ফলে যেসব আপত্তিকর স্লোগান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পক্ষটিকেই বহন করতে হবে।”
তোপের মুখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
৮ মে দিনাজপুরে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
সেখানে তিনি বলেন, “সাবেক রাষ্ট্রপতি দেশত্যাগের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় না নিয়ে আসতে পারলে আমি চলে যাব।”
“তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হবে”- এমন একটি বক্তব্যও দেন তিনি।
দু-দিন পর উপদেষ্টা যান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এই সফরের কারণ ছিল, বিদেশ ভ্রমণের পদ্ধতির বিষয়ে জানা।
তিন পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি
৮ মে রাতে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে একটি বক্তব্য আসে সংবাদ মাধ্যমে। এতে লেখা হয়,
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার ঘটনায় ‘দায়িত্বে অবহেলার’ অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদের এক কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার এবং দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তর।
তবে ওই বার্তায় তাদের নাম বলা হয়নি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরার পর শাস্তি পাওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত বাহিনীটির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও গণসংযোগ) এনামুল হক সাগর ফোন ধরেননি।
তিন উপদেষ্টার নেতৃত্বে ‘উচ্চ পর্যায়ের’ কমিটি
১১ মে উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আবদুল হামিদ কীভাবে বিদেশে গেলেন, সেই বিষয়টি তদন্তে শিক্ষা উপদেষ্টাকে সি আর আবরারকে প্রধান করে তিন উপদেষ্টার ‘উচ্চপর্যায়ের’ কমিটি গঠন করেছে সরকার।
বাকি দুই উপদেষ্টা হলেন পরিবেশের দায়িত্ব পাওয়া সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এম সাখাওয়াত হোসেন।
কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়ার কথাও জানানো হয়।
সেই ১৫ দিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত ২৬ মে। তবে প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের তরফে আর কিছু জানানো হয়নি।
উপদেষ্টা রিজওয়ানার কাছ থেকে কিছু জানা গেল না। তিনি মেসেজ লিখে পাঠান, “অনুগ্রহ করে অধ্যাপক আবরারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলুন। তিনি এই কমিটির প্রধান।”
শ্রম উপদেষ্টাও বললেন, ‘এ বিষয়ে সি আর আবরারকে জিজ্ঞেস করবেন। কারণ উনিই কমিটির প্রধান, নট মি।’’
কেন তিনি বলবেন না, তার একটি ব্যাখ্যাও দেন সাখাওয়াত। বলেন, ‘‘আমি উপদেষ্টা হলেও কমিটির প্রধান সি আর আবরার আর আমি কমিটির সদস্য। এক নম্বর হলো, উনার হুকুম ছাড়া আমি কোনো কিছুই করতে পারব না। দ্বিতীয় বিষয় হলো- এই মুহূর্তে আমি দেশের বাইরে, জেনেভায়। এ বিষয়ে উনাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। উনি আমাকে মুখপাত্র বানান নি, এ জন্য আমি বলতে পারব না।’’
তবে সিআর আবরার ফোন ধরলেন না, তাকে মেসেজ দেওয়া হলে তারও জবাব আসেনি।
আইভী গ্রেপ্তার
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বাসাতেই ছিলেন।
আবদুল হামিদ দেশের বাইরে যাওয়ার পর ৯ মে তার সেই বাসায় অভিযানে যায় পুলিশ। আইভীর সমর্থকরা ছয় ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে গ্রেপ্তার ঠেকানোর চেষ্টা করে।
তবে সারা রাত পুলিশকে বাইরে অপেক্ষা করিয়ে রাখার পর ভোর পৌনে ৬টার দিকে আইভী বাইরে বের হয়ে আসেন।
আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে যে মামলা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় সাড়ে চার মাস পর কিশোরগঞ্জ সদর থানায় আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। এসে আসামি হিসেবে আছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও।
মামলা থাকার পরও কেন দেশত্যাগের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, তার দেশত্যাগের বিষয়ে আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও ছিল না।
আবদুল হামিদ বাংলাদেশের ২০ ও একবিংশতম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল বঙ্গভবন ছাড়ার দিন রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।