
গত ৩ জুন ইশরাক হোসেন জানিয়েছিলেন সরকার শপথের আয়োজন না করলে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে শপথ নিয়ে মেয়রের চেয়ার দখল করবেন। এর ১৪ দিনের মাথায় শপথ প্রশ্নে নিজের অবস্থান পাল্টিয়েছেন বিএনপির এই নেতা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শপথ না নেওয়া পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন না বলেন জানিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার সকালে নগর ভবনের সামনে বিএনপির ঘোষিত গণঅবস্থান কর্মসূচি শেষে নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানান ইশরাক।
তবে নাগরিকদের জরুরি সেবা যেন বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইশরাক হোসেন বলেন, “শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমি মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারছি না। তবে আন্দোলনের শুরু থেকেই নগরবাসীর জরুরি সেবা অব্যাহত রয়েছে এবং তা যেন চলমান থাকে, সে বিষয়ে আমি দায়িত্বশীল আচরণ করছি।”
তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ‘ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন এবং শপথ ভঙ্গ করে নিজের নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তাই তার পদত্যাগের দাবি জানান ইশরাক।
ইশরাক হোসেন আরও বলেন, “অভিজ্ঞতা কম থাকার কারণে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা গণমাধ্যমে এমন তথ্য দিয়েছেন, যা আইনবিরুদ্ধ এবং ভবিষ্যতে নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধিকে শপথ গ্রহণে নিরুৎসাহিত করতে পারে। তিনি রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে লাভবান হতে অবৈধভাবে লোক বসিয়ে প্রশাসনের অপব্যবহার করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আসিফ মাহমুদের সংশ্লিষ্টতা থাকা সব অপকর্মের তদন্ত করব।”
এই সময় তিনি প্রধান উপদেষ্টাকেও দায় না এড়িয়ে ‘যৌক্তিক সমাধানের’ আহ্বান জানান।
যদি দাবি না মানা হয়, তাহলে আন্দোলন নগরভবনের গণ্ডি পেরিয়ে রাজপথে ছড়িয়ে পড়বে বলেও হুঁশিয়ারি দেন ইশরাক।
তিনি বলেন, “আমরা আন্দোলনে যেতে চাইনি। সরকার আমাদের বাধ্য করেছে।”
আন্দোলনে নগর ভবন অচলাবস্থার জন্য এই সরকার, প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা দায়ী বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা।
সোমবার ছিলেন ‘মাননীয় মেয়র’
সোমবার নগর ভবনে ঢুকে কনফারেন্স রুমে সভা করেছেন ইশরাক হোসেন। সভার ব্যানারে ইশরাক হোসেনের নামের আগে ‘মাননীয় মেয়র’ লেখা ছিল।
এদিন নগর ভবনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। পরিচ্ছন্ন ঢাকা ও নাগরিক সেবা নিশ্চিতকল্পে এই সভার আয়োজন করা হয় বলে আয়োজকরা জানান।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ইশরাক হোসেন। ব্যানারে তার নামের আগে ‘মাননীয় মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন’ লেখা ছিল। সভায় ইশরাক হোসনকে ফুলেল শুভেচ্ছা দিতেও দেখা যায়।
সোমবার বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে নগর ভবনের সামনে ফের অবস্থান নেন তার সমর্থকরা। পরে বেলা ১১টার পর নগর ভবনে আসেন ইশরাক হোসেন।
রোববারের ঘোষণা অনুযায়ী, জরুরি সেবার চালু রাখতে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগ দেন তিনি।
নিজে ‘শপথ’ নিয়ে ‘চেয়ার দখলের’ ঘোষণা
ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে ১৪ মে থেকে আন্দোলন শুরু করেন তার সমর্থকরা। ৩ জুন নগরভবনে চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন বলেন, “শপথ যদি না করায়, তাহলে চেয়ারে গিয়ে বসতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না। ঢাকা শহরের জনগণ আমাকে বারবার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমি শহীদ মিনারে গিয়ে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে শপথ পড়ে দায়িত্ব গ্রহণ আমি নিজেই কেন নিচ্ছি না। তখন বলেছি, যেহেতু আমরা একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বাসী, আমরা চাই না কোনো ধরনের বাজে উদাহরণ সৃষ্টি হোক।”
বিএনপির বৈদেশিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন বলেন, “এই সরকারকে এখন বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে, আপনারা যদি শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা না করেন, তাহলে ঢাকা দক্ষিণের ভোটারদের সঙ্গে করে আমি নিজেই শপথ নিয়ে আমি আমার চেয়ার দখল করব। নগর ভবন কীভাবে চলবে সেটা ঢাকাবাসী নির্ধারণ করবে। বহিরাগত কোনো উপদেষ্টা বা প্রশাসককে দিয়ে নগর ভবন পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। এটাই আমাদের শেষ কথা, এটাই আমাদের শেষ বার্তা।”
আদালতের রায়ে মেয়রের পদ ফিরে পাওয়ার পর শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ার প্রতিবাদে গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে আসছিলেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকেরা। পরদিন এই কর্মসূচিতে সংহতি জানায় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ। ওই দিন নগর ভবনের মূল ভবনের সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এতে ১৫ মে থেকে নগর ভবনের সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ৩ জুন ইশরাক হোসেন বলেন, “সামনে যেহেতু ঈদ। জনভোগান্তির কথা সামনে রেখে নগর ভবন অবরোধ বা ঘেরাওয়ের যে কর্মসূচি, সেটিতে কিছুটা শিথিল ও বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে ছুটির পরে যখনই শপথের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না আসে, আমরা তখন ঢাকা দক্ষিণের সর্বস্তরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে ঢাকাবাসীর ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব।”
সিটি করপোরেশনকে স্থবির করে ফেলার মাধ্যমে যে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে, এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, “এর দায় পুরোপুরি অন্তর্বর্তী সরকার ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায়। তাঁরা শপথ আয়োজন না করে সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সর্বোচ্চ আদালত অবমাননা করেছেন।”
প্রায় ৫ বছর পর ইশরাককে মেয়র ঘোষণা
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্বাচনের ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেয় আদালত। গত ২৭ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম এ রায় দেন।
২০২০ সালের ৩ মার্চ অনিয়ম, দুর্নীতি ও অগ্রহণযোগ্যতার অভিযোগে ডিএসসিসি নির্বাচন ও ফলাফল বাতিল চেয়ে মামলা করেছিলেন মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন। মামলায় তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা, রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসসহ মোট আট জনকে আসামি করা হয়।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম উত্তরে ও ফজলে নূর তাপস দক্ষিণের মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের গেজেট প্রকাশ করেন। তারা শপথ গ্রহণ করে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গত বছর ১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস এলাকা থেকে সাবেক মেয়র আতিককে গ্রেফতার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। পরে তাকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। এদিকে সরকার পতনের পর থেকে ফজলে নূর তাপস পলাতক রয়েছেন।
রায়ের পরও শপথ হয়নি ইশরাকের
আদালতের রায়, নির্বাচন কমিশনের গেজেটের পরও শপথ হয়নি ইশরাকের। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার আইনি জটিলতার কথা জানায়।
মার্চ ইশরাককে আদালত বিজয়ী ঘোষণার পরে নির্বাচন কমিশন থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেট হাতে পাওয়ার পরপরই স্থানীয় সরকার বিভাগ শপথের প্রস্তুতি শুরু করেছিল। কিন্তু আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের মতামত চাইলেও মতামত দেওয়ার অপেক্ষা না করেই গেজেট নোটিফিকেশন করেছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করেনি।”
আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের আপিল না করা এবং বরিশাল সিটি করপোরেশনের পরাজিত প্রার্থীর একই ধরনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করে ইসির পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি গেজেট প্রকাশের অভিযোগ তোলা হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির পক্ষ থেকেও। তবে বিএনপির বৈদেশিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনের দাবি, আইনি যুদ্ধে তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এখন শপথ নেওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
এদিকে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে দেওয়া রায় স্থগিতের পাশাপাশি তাকে মেয়র পদে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এরইমধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী মেয়র পদে মেয়াদ শেষ হয় ২ জুন।