গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি: নতুন চেতনার উন্মেষ

তাসীন মল্লিক ও মনিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬:৪৯

গণঅভ্যুত্থান চলাকালে রকিশাচালক নূর মোহাম্মদ গুলবিদ্ধি শক্ষর্িাথী নাফজিকে হাসপাতালে নয়িে যাওয়ার চষ্টো করওে বাঁচাতে পারনেনি।
প্রায় এক বছর আগে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনেই থেমে থাকেনি, তাৎক্ষণিক লক্ষ্য পূরণের পর মুহূর্তেই বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদলে একটি নতুন ব্যবস্থার গণদাবির উদ্ভব ঘটে। দেশের মানুষের মনে উন্মেষ ঘটে নতুন রাজনৈতিক চেতনার।
অভ্যুত্থানের পর শহর থেকে গ্রামের পথে-প্রান্তরে, হাটে-বাজারে মানুষের প্রশ্ন “আমরা কীভাবে শাসিত হচ্ছি?”, “এই রাষ্ট্রের মালিকানা আসলে কার?”। তারা রাজনীতি বুঝতে চায়, সংবিধান জানতে চায়, এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত—সেটা নিয়ে মতামত দিতে চায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশিষ্টজনদের মতে, অভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষের চিন্তাজগতে নতুন ধরণের রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। মানুষ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির কর্মসূচির বদলে রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনায় বেশি আগ্রহী।
শিক্ষাবিদ আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘‘এবারের গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষিত মানুষজন সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন, সেটা বুঝে হোক না বুঝে হোক। প্রান্তিক মানুষরা হয়তো সেভাবে বলছেন না, তবে তারাও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাটা বদলানো বিষয়টি নানাভাবে বলছেন। অন্য যেকোনো অভ্যুত্থানের চেয়ে এবারের অভ্যুত্থান এ জন্যই আলাদা।’’
জনতার অনিবার্য প্রতিরোধ
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি সামাজিক বিস্ফোরণের পরিণতি। দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় শোষণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গণপরিবহনে নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে ঊর্ধ্বমুখী প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, এবং একের পর এক রাজনৈতিক সংকটে জনমনে জন্ম নেয় এক গভীর হতাশা। সেই হতাশা অনিবার্য প্রতিরোধ হয়ে একসময় ঠাঁই নেয় রাজপথে। তবে সেই প্রতিরোধ কেবল রাজপথে সংঘটিত একদিনের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। গণমানুষের বিপুল রক্তক্ষয়ের পর পরাস্ত হয় শোষক।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “জাতির অনেক অর্জনের মধ্যে জুলাই বিপ্লব একটি অর্জন... এর প্রথম বর্ষপূর্তি পালনকরতে যাচ্ছি আমরা। যাদের সন্তানেরা গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, তাদেরকে বিশেষ সম্মান জানাতে হবে। এই ত্যাগের মহিমা যেন সুন্দর দেশ গড়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এই ত্যাগ বিশেষ কোনো দলের নয়, এই ত্যাগ সর্বসাধারণের।
“তাছাড়া আমরা শহীদ ও আহত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি এবং করছি। আমরা মনে করি, একটি কমিশন বা সংস্থার মাধ্যমে শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়াব। আমাদের এ ধরণের কাজ অব্যাহত থাকবে।”
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অন্যতম এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন দেশকাল নিউজকে বলেন, “বাংলাদেশে দীর্ঘসময় ধরে যে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসেছিল তার বিরুদ্ধে জনমনে তীব্র ক্ষোভ এবং ঘৃণা সঞ্চারিত হয়। দীর্ঘসময় ব্যাপী বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু এসব আন্দোলন সফলতা অর্জন করতে পারেনি।”
তার ভাষায়, ‘‘চব্বিশের আন্দোলনের সময় ছাত্রদের সুনিপুণ নেতৃত্ব, দীর্ঘ সময় ধরে থাকা পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, সরকারের চূড়ান্ত আগ্রাসী আক্রমণ এবং সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে এই আন্দোলন সফল হয় এবং হাসিনা পালিয়ে যায়।’’
রাজনীতিতে আগ্রহ বেড়েছে তরুণদের
অভ্যুত্থানের পর লক্ষ্য করা গেছে, রাজনীতি বিষয়ে যে ‘নীরবতা সংস্কৃতি’ সমাজে বিরাজ করত, সেটি ভেঙে গেছে। এখন চায়ের দোকানে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, এমনকি গ্রামীণ হাটেও আলোচনা হয়—‘সংবিধানের কোন ধারা বদলানো দরকার’, ‘নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী হওয়া উচিত’, কিংবা ‘আমরা সংসদে কেমন প্রতিনিধিত্ব চাই’।
বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই রাজনৈতিক আগ্রহ বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। অভ্যুত্থানের পর স্পষ্টভাবে একটি দাবি উঠে এসেছে—রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিকভাবে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু তা কেবল নির্বাচন নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংবিধান সংস্কার, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, এবং আইনপ্রণয়নে জনসম্পৃক্ততা। মানুষ এখন আর শুধু নির্বাচনের সময়েই নয়, সারা বছরজুড়ে নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে চায়। এই অংশগ্রহণমুখী গণতন্ত্রের ধারণা থেকেই এসেছে সংলাপভিত্তিক রাজনীতির চর্চা।
নতুন ধারার নাগরিক সক্রিয়তা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে গড়ে উঠেছে এক নতুন ধরনের নাগরিক সক্রিয়তা। মানুষ এখন রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ও নীতিনির্ধারণে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে নিত্যনতুন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
তেমনই একজন রাজধানীর ঝিগাতলার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী শহীদউদ্দিন অনু। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি রাজনীতি নিয়ে লেখা বইপত্র পড়া শুরু করেন। দেশকাল নিউজকে শহীদউদ্দিন বলেন, ‘‘জুলাই মাসে চোখের সামনে অনেক মানুষকে মরতে দেখছি। এই যে এই সাইন্সল্যাবে এত হত্যার ঘটনা ঘটল, ক্ষমতার জন্য তো বারবার এমন ঘটনা ঘটা ঠিক হবে না। আগে রাজনীতি নিয়ে ভাবতাম না, কিন্তু রাজনীতিই এখন রাজনীতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে।”
এছাড়া শিক্ষিত সমাজে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করছেন, কেউ কেউ স্থানীয় পর্যায়ে গণশুনানি ও জনমত জরিপ আয়োজন করছেন। তরুণদের একাংশ রাজনীতি ও সংবিধান নিয়ে পাঠচক্র গঠন করছে, আবার কেউ বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে।
এই সক্রিয়তা নেতৃত্ববিহীন হলেও সংগঠিত, ব্যক্তিক হলেও সম্মিলিত। এর মধ্যে আছে গণতন্ত্রের গভীরতর চর্চা, এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিক দায়বদ্ধতার নতুন অভিব্যক্তি। এটি প্রমাণ করে, অভ্যুত্থান কেবল প্রতিক্রিয়া ছিল না—তা ছিল দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে একটি সক্রিয় বিকল্প পথের সন্ধান।
বাংলামোটর মোড়ে রিকশাচালক মো. হাসান জানান, সুযোগ পেলেই তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনছেন। দেশকাল নিউজকে তিনি বলেন, “মিটিং—মিছিল দেখলেই শুনি নেতারা কী কয়। তাগো কথা শুইনাই বুঝি কে কী চায়, ভোট আইলে তাগোরে বুঝায় দিমু।”
জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে উদ্যোগ
শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়, গোটা রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার— এই দাবি মাথায় রেখেই গত বছরের ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে তাদের প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল— গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রে কাঠামোগত সংস্কার। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন করে একাধিক বিষয়ভিত্তিক কমিশন। কমিশনগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে আলাদা আলাদা পরামর্শ ও সুপারিশ তৈরি করে। পরে এসব সুপারিশ নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে সরকার পরে গঠন করে ‘ঐকমত্য কমিশন’।
তবে সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে এখন নানা সংশয় ও সংকট তৈরি হয়েছে। যে স্বপ্ন বা আকাঙক্ষায় গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সেটি একবছরে কেমন পূরণ হয়েছে জানতে চাইলে আখতার হোসেন বলেন, ‘‘চব্বিশের অভ্যুত্থানকে ঘিরে আমাদের আশা ছিল আকাশচুম্বী। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এক বছর পরে এসে এটির খুব সামান্যই বাস্তবায়ন হয়েছে।
তিনি বলেন, “পূর্বের বাংলাদেশে যারা বিরোধী মত বা শক্তি তারা চূড়ান্তভাবে কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। মানবাধিকারের লঙ্ঘন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। বাক স্বাধীনতার কোনো বালাই ছিল না। এই বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের একটি অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। মানুষেরা বাক স্বাধীনতার চর্চা করতে পারছেন।”
এনসিপির এই নেতা বলেন, “গুম খুন ক্রসফায়ারের মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে না। সব রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। কিন্তু নতুন কাঠামোর যে বাংলাদেশের কথা বলেছি আমরা, যার জন্য ঐক্যমত্য কমিশন এখন জুলাই সনদের কাজ করছে। যদিও এটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবুও আমরা আশাবাদী। একটা বিপ্লবের সঙ্গে গোটা সমাজের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তনের সঙ্গে যে আকাঙক্ষা যুক্ত থাকে সেটি পরিপূর্ণভাবে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে।’’
সংস্কার নিয়ে সংশয়
সংস্কার নিয়ে দ্বিমতও প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর ভাষ্য সংস্কার নিয়ে সার্বজনীন আলোচনা অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, ‘‘মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে শুধু প্রস্তাব আর বিরোধিতার খবর আসে, কিন্তু সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা, যুক্তি ও সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে জনগণের সামনে কোনো বিশ্লেষণ আসে না। অথচ দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য যদি সংস্কার হয়, তাহলে তাদের জানার অধিকারও থাকা উচিত। জনগণই আসল স্টেকহোল্ডার—রাজনৈতিক দল নয়। অথচ আজ সবকিছু হচ্ছে জনগণকে পাশ কাটিয়ে।’’
মাহবুব উল্লাহ আরও বলছেন, ‘‘এখন আর ঢেকে চলার রাজনীতি দিয়ে হবে না। আমাদের দরকার বুঝে চলার রাজনীতি—যেখানে থাকবে নীতিবোধ, শ্রেয়বোধ, এবং সচেতন জনগণের সংগঠিত শক্তি। সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক সংস্কার কেবল তখনই সম্ভব, যখন মানুষ নিজেই পরিবর্তনের কেন্দ্রে থাকবে।
‘‘গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠে এলেও জনগণের সামনে এখনো স্পষ্ট নয়—আসলে কী কী সংস্কার প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর বাস্তবতা কতটা এবং তা দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক। আমার মতো মানুষও এখন পর্যন্ত সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে পাইনি, চেষ্টাও করেছি, তবু পাওয়া যায়নি। কিছু সুপারিশ সম্পর্কে যা জানি, তার মধ্যে কিছু সুপারিশ বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং তা দেশে অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।’’
মাহবুব উল্লাহ আরও বলেন, ‘‘দেশকে আটটি প্রদেশে ভাগ করার মতো প্রস্তাব রয়েছে, যা বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে পারে। আবার, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা নিয়ে যে তর্ক চলছে, সেটিও বাস্তবতা বিবর্জিত। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের অনেক দেশেই এটি নেই—যেমন ভারত বা ব্রিটেন। ফলে এটি বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।’’