Logo
×

Follow Us

রাজনীতি

হাসিনার পতন: বিবিসির তথ্যচিত্রে রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান

Icon

তৌসিফ আহমেদ ও স্বর্ণা রায়

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১৭:৪১

হাসিনার পতন: বিবিসির তথ্যচিত্রে রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান

যাত্রাবাড়ীতে শেখ হাসিনার নির্দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছোড়ে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলন যা পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তৎকালীন সরকারের দমননীতি এবং শেখ হাসিনার পতন নিয়ে একটি বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। বুধবার ইউটিউবে ‘দ্য ব্যাটল ফর বাংলাদেশ: ফল অব শেখ হাসিনা’ শিরোনামের এই তথ্যচিত্রে অপ্রকাশিত ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ সদস্যের ভাষ্য এবং ফাঁস হওয়া নথিপত্রের মাধ্যমে তুলে আনা হয়েছে সেই সময়ের রক্তরঞ্জিত ঘটনাবলীর পেছনের কাহিনী।

বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কীভাবে একটি বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং বিশেষ করে ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে কীভাবে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এই হত্যাযজ্ঞের নির্দেশ কে দিয়েছিল এবং এতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভূমিকা কী ছিল।

প্রতিবাদের শুরু ও আবু সাঈদের মৃত্যু

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। এর বিস্ফোরণ ঘটে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের পর। দেশের মোট চাকরির প্রায় ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত রাখার এই আইনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে।

শিক্ষার্থী রাসেল মাহমুদের মতো আন্দোলন সমন্বয়কারীরা বলেন, “যখন আমি কোটা পদ্ধতির বৈষম্যমূলক দিকটি দেখলাম, আমি বুঝতে পারলাম যে আমিও এই বৈষম্যের শিকার হতে পারি এবং একটি ভালো চাকরি নাও পেতে পারি।”

এই আন্দোলন বৈপ্লবিক রূপ নেয় ১৬ জুলাই, যখন পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে ২৩ বছর বয়সী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হন। একাধিক শটগানের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত সাঈদের হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মৃত্যু হয়। এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। আন্দোলনকারীরা একে ‘গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবে ঘোষণা করেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও কঠোর দমননীতি

ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মুখে ১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষণে তিনি বলেন, “এই আন্দোলনের শুরু থেকে সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে... আন্দোলনরত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় পুলিশ সহযোগিতা করেছে।”

কিন্তু বিবিসির প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এই ভাষণের পরপরই পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে ওঠে। দেশব্যাপী ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়।

বিবিসি আই-এর যাচাইকৃত একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা নিজে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়-

“সবগুলিকে আমি অ্যারেস্ট করতে বলেছি রাত্রে। সবাইকে বলা হচ্ছে- যে যেখান থেকে যে কটা পাবা, ধরে ফেলবা।” 

তিনি আরও বলেন,

“না, আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে একটা। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি এখন। এখন থেকে লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে।”

বিবিসি বলছে, এই ফাঁস হওয়া অডিও প্রমাণ করে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ‘যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করা’।

রণক্ষেত্র যাত্রাবাড়ী: ফাঁস হওয়া নথিতে ভয়াবহ চিত্র

আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকার প্রবেশদ্বার যাত্রাবাড়ী। রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এই এলাকা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আন্দোলনকারীরা বারবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন।

বিবিসির হাতে আসা যাত্রাবাড়ী থানার নথি বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ সেখানে আন্দোলন দমনে লাইভ অ্যামুনেশন এবং সামরিক গ্রেডের রাইফেল ব্যবহার করেছিল। ২০ জুলাই মহাসড়কে একটি বড় অভিযান চালানো হয়। সেদিন পুলিশ মোট ২,৪৪৪ রাউন্ড গুলি ছোড়ে, যার মধ্যে ৬৯৫ রাউন্ড ছিল অ্যাসল্ট রাইফেলের।

ওই দিনই পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইমাম হাসান তাইম। তাকে মারধরের পর গুলি করার দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়ে।

৫ আগস্ট: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড

প্রতিবেদনটির মূল ফোকাস ছিল ৫ আগস্টের ঘটনা, যেদিন ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেয়। আন্দোলনকারী মিরাজ ও শাওনের মতো তরুণরাও সেদিন রাজপথে নেমেছিলেন এই বিশ্বাসে যে, ‘আজ কিছু একটা ভালো হবে’।

বিবিসির শত শত ভিডিও, ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বিশ্লেষণ করে তৈরি করা ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়:

দুপুর ১:২৬: যাত্রাবাড়ী থানার কাছে টোল প্লাজায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী নাজরিন বলেন, “প্রথমে আমরা স্নাইপারের গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর খবর শুনি।”

১:৫৫: পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

সেনাবাহিনীর আগমন: কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনী এসে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মাঝে অবস্থান নেয়। এসময় শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে ভয় কেটে যায় এবং তারা আবার থানার দিকে এগোতে থাকে।

হাসিনার পলায়ন (দুপুর ২:২৫): সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে জানায় যে তারা বিক্ষোভকারীদের তার বাসভবনে পৌঁছানো থেকে আটকাতে পারবে না। এরপরই তিনি হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যান।

সেনাবাহিনীর রহস্যজনক প্রত্যাহার: শেখ হাসিনার পলায়নের খবরে যখন যাত্রাবাড়ীতে উৎসবমুখর পরিবেশ, তখন হঠাৎ করেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানার সামনে থেকে সরে যায়। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “হয়তো সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে তাদের সরে যেতে বলা হয়েছিল, কারণ পুলিশ কিছু একটা করতে যাচ্ছিল।”

মূল হত্যাকাণ্ড (দুপুর ২:৪৩): সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুলিশ স্টেশন থেকে এবং ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর আবারও নির্বিচারে গুলি শুরু হয়। একজন বলেন, “তারা একের পর এক মানুষকে গুলি করছিল। মারতে মারতে দৌড়াতে বলছিল, তারপর গুলি করছিল। এই ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।”

এই গোলাগুলির মধ্যেই নিজের মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মিরাজ। তার বন্ধু শাওন সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে বলেন, “কিছুক্ষণ আগেও যে বন্ধু আমার সাথে ছিল, এখন সে নেই... আমি তো তাকে ধরতে পারি নাই।”

এই সহিংসতার সময় তোলা ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ যখন গুলি চালাচ্ছিল, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তখনও সে এলাকাতেই ছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের প্রশ্ন করছিল- 

আপনারা কিছু বলেন স্যার, তারা এভাবে গুলি করল ক্যান? “আপনাদের চোখের সামনে কতোডি মানুষ মারল স্যার!এডি বলেন? কিভাবে পইড়া রইছে দেখেন গিয়া!”

কার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড?

বিবিসির অনুসন্ধানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী কে? প্রতিবেদনে একটি ‘চেইন অব কমান্ড’ তুলে ধরা হয়েছে:

শেখ হাসিনা: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থার নেতৃত্বে ছিলেন। তার নির্দেশেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয়।

আসাদুজ্জামান খান কামাল: তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পুলিশের দায়িত্বে ছিলেন।

হাবিবুর রহমান: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন কমিশনার, যিনি সেন্ট্রাল কমান্ড রুম থেকে নির্দেশ দেন।

হারুন-অর-রশিদ: ডিবি প্রধান, যাকে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশকে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়।

আবুল হাসান: যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি, যিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আবুল হাসানসহ প্রায় ৬০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও আরও অনেকে পলাতক। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যায় উসকানি, ষড়যন্ত্র এবং তা প্রতিরোধে ব্যর্থতাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

শোক ও নতুন দিনের আশা

প্রতিবেদনের শেষে নিহত মিরাজের পরিবারের শোক ও সাহসের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তার ভাই জানান, আমরা এটা ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দিই যে আমার ভাইয়ের আত্মত্যাগ, তার রক্ত স্বৈরাচার থেকে দেশকে মুক্ত করতে এবং একটি নতুন জাতি গঠনে সাহায্য করেছে।

আন্দোলনকারী শাওন বলেন-

“আশা রাখতে পারি... আশায় তো মানুষ বুক বাঁধে। আশা ছাড়া তো আমাদের কিছুই করার নেই। বাংলাদেশে যেন এরকম কখনোই না হয়। কারণ, একটা মানুষ যদি ক্ষমতার জন্য যদি... এত মানুষ প্রাণ না হারায়। ও (মিরাজ) ন্যায়বিচারটা পাক, এটাই আমি চাই।”


তথ্যসূত্র: বিবিসির ‘দ্য ব্যাটল ফর বাংলাদেশ: ফল অব শেখ হাসিনা’ তথ্যচিত্র

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫