
প্রতীকী চিত্র।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা এবং তাদের বাড়িঘরে ধারাবাহিক সংঘবদ্ধ হামলা হতে থাকে। অতীতে দেশে সংঘবদ্ধ হামলার বহু নজির রয়েছে, কিন্তু পূর্বের হামলার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের পর সংঘটিত সংঘবদ্ধ হামলার ভিন্নতা রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংঘবদ্ধ হামলাগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোনো বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে হামলার পূর্বে হ্যান্ড মাইকে বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত বা সহযোগী’ ঘোষণা দিয়ে আশপাশের মানুষকে হামলায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং পরবর্তী সময়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটতরাজের পর আগুন দেওয়া হচ্ছে। ‘ব্যক্তি’র ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধভাবে শারীরিক নির্যাতনের পর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আক্রমণের শিকার ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে হরেদরে। ব্যাপকভাবে ঘটতে থাকা এই সংঘবদ্ধ হামলা সংবাদমাধ্যমে ‘মব ভায়োলেন্স’ এবং ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিতি লাভ করে, ফলে ‘মব’ শব্দটির উৎপত্তি ও ইতিহাসের বিষয়ে অনেকের মাঝেই কৌতূহল জাগে। চলুন তবে জেনে আসা যাক ‘মব’ শব্দটির উৎপত্তি এবং এই সংশ্লিষ্ট ইতিহাস।
‘মব’ শব্দের উৎপত্তি
১৬৮৮-৮৯ সময়কালে ইংল্যান্ডে ‘গ্লোরিয়াস রেভল্যুশন’ বা ‘মহিমান্বিত বিপ্লব’ সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্যাথলিক রাজা দ্বিতীয় জেমস তার প্রোটেস্ট্যান্ট কন্যা মেরি ও ডাচ জামাতা উইলিয়াম অব অরেঞ্জ কর্তৃক উৎখাত হয়েছিলেন। মূলত এই গ্লোরিয়াস রেভল্যুশনের সময় ‘মব’ শব্দটি আলোচনায় উঠে আসে। ল্যাটিন শব্দ ‘সড়নরষব াঁষমঁং’ থেকে ‘মব’ শব্দটি এসেছে বলে ভাষাবিদরা মনে করেন। যার অর্থ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’।
প্রথম মৃত্যু
ধারণা করা হয় মবের প্রভাবে মৃত্যুর প্রথম ঘটনাটি ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঘটনাটির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য হিস্টরি’ চ্যানেলের তথ্য মতে, ১৬৯২ ও ১৬৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস-এ ২০ জন নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা ঘটে। কালো জাদুচর্চার অভিযোগে তাদের ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করা হয়। বিচারককে প্রভাবিত করা হয়। বিচারকের প্রভাবিত হওয়া বা মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের পেছনে কাজ করেছে সংঘবদ্ধ মানুষের আক্রমণের ভয় অর্থাৎ ‘মব’, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও কুসংস্কার।
ভারত ও পাকিস্তান
মব জাস্টিসের প্রসঙ্গ এলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তানের নাম ওপরের দিকেই আসে। মিডল ইস্ট আইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ‘গত বছরের ৪ জুন ভারতে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।’ এ ছাড়াও ভারতে গরু ও গরুর মাংস বহনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। গোরক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলোর ইন্ধনে মব জাস্টিসের কবলে ভারতের অনেক মুসলমান নাগরিককে পুড়িয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৭ জুন ছত্তিশগড় রাজ্যের রাইপুরে গরু চোরাচালানের অভিযোগে দুই মুসলিম ব্যক্তিকে মারধর করে হিন্দুত্ববাদী উচ্ছৃঙ্খল জনতা। ওই ঘটনায় আহত হওয়া একজন কিছুদিন পরে মারা যান। একই বছরের ১৮ ও ২২ জুন উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটে পৃথক ঘটনায় দুজন মুসলিমকে সংঘবদ্ধভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ জুন ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদা জেলায় এক নারীকে হত্যা করে সংঘবদ্ধ হিন্দত্ববাদীরা। মবের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ওই নারী ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে উচ্ছৃঙ্খল জনতার আইন হাতে তুলে নেওয়া খবর প্রায়ই খবরের শিরোনামে উঠে আসে। বিবিসি জানাচ্ছে, ‘দেশটিতে মব জাস্টিসের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদ জেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি ও গির্জায় প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার পর ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া গত বছরের জুনে খাইবার পাখতুনখোওয়া প্রদেশের সোয়াত জেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে থানা থেকে একজন খ্রিষ্টান পর্যটককে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা সে সময় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল।’
আফ্রিকায় ভয়ংকর রূপ
আফ্রিকার দেশগুলোতেও ‘মব’ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা, ঘানা ও কেনিয়ায় মব জাস্টিসের প্রবণতা বেশি বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ঘানার কয়ামে এনক্রুমাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইনের অধ্যাপক মামে এফুজা আদ্দাদজি-কুম। তিনি বলেন, এই দেশগুলোতে যে ধরনের অপরাধ বা ঘটনা মব জাস্টিসকে প্ররোচিত করেছে, তার মধ্যে চুরি ও ডাকাতি বেশি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে গত এক দশকে নাইজেরিয়ায় অন্তত ৫৫৫ জন মব জাস্টিসের শিকার হয়েছে। আর ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘হোয়াই উই কিল’ বইয়ের লেখক কার্ল কেম্পের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৭ হাজার মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। এর মধ্যে এক হাজার ৮৯৪ জন অর্থাৎ প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ মব জাস্টিসে প্রাণ হারিয়েছিল। সংখ্যাটা ছিল আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ‘মব’ বা ‘মব জাস্টিস’ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছে।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত দেশে গণপিটুনির ঘটনায় অন্তত ৯৪ জন নিহত হয়েছে!
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে দেশে ‘মব জাস্টিস’-এর ঘটনা এখনো সে অর্থে কমেনি, যা সত্যিই উদ্বেগজনক।