রাজনীতির মিছিলে শিশুর কণ্ঠস্বর, অন্য রকম বাংলাদেশ

আলপনা আকতার শ্রাবনী
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৩:০২

মুখে শাপলা-শাপলা স্লোগান নিয়ে কেউ কাঁধে, কেউবা হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে। বর্ষার ভেজা মাটির গন্ধে যেন ভরপুর তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ। শিশুদের নিয়ে এই দৃশ্য স্বপ্ন নয়, বরং দেশের কুড়িগ্রামের গলিপথ থেকে উঠে এসেছে-এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রার’ এক অনন্য মুহূর্ত।
একটা সময় ছিল, যখন রাজনীতি মানেই ছিল বড়দের বিষয়। বক্তৃতার মঞ্চ, মিছিলের স্লোগান কিংবা মতের পার্থক্য, সবকিছুই প্রাপ্তবয়স্কদের জগতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। আর এই বদলে যাওয়ার গল্পটা এবার ফুটে উঠছে আমাদের দেশের ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্য দিয়ে।
এনসিপির চলমান পদযাত্রায় যেভাবে শিশুরা অংশ নিচ্ছে, সেটি শুধু অভাবনীয় নয়, বরং এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার চিহ্নও বটে। বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধে যখন রাজপথ সিক্ত, তখন হঠাৎই কোথাও শোনা যাচ্ছে শিশু কণ্ঠের স্লোগান ‘শাপলা, শাপলা’, ‘এনসিপি, এনসিপি!’ এই দৃশ্য শুধু মিছিলের উত্তাপই বাড়ায় না, বরং এনে দেয় এক ভালো লাগা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে মাসব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারগুলোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রতিটি এলাকার শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে চলেছে গত ১ জুলাই থেকে। পথের পরে পথ হেঁটে তারা বাংলার পথঘাটের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করে চলেছে। তাদের এই পদযাত্রায় দূরবর্তী এলাকায়ও দেখা যাচ্ছে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুরা সারি ধরে হাঁটছে, কখনো মজা করতে করতে, কখনো গম্ভীর মুখে শোনাচ্ছে তাদের মতো করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
তাদের চোখে নেই কোনো রাজনৈতিক জটিলতা, স্বার্থপর হিসাব, আছে কেবল নিষ্পাপ বিশ্বাস তার দেশের প্রতি ভালোবাসা। তারা জানে না ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য। তারা শুধু চায় একটি নিরাপদ দেশ, হাসিমাখা শৈশব, স্কুলে যাওয়া এবং খেলার মাঠে নির্ভয়ে দৌড়ানো। আর সেই দেশ গড়ার অভিযানে যদি তাদের ছোট্ট পা কিছুদূর হাঁটে, তবে তাতে দোষ কোথায়?
বাচ্চাদের এই নিষ্পাপ চাওয়া নিয়ে নতুন বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নের পদযাত্রায় ঠাঁই দিল এনসিপি। যেখানে শিশুদের উপস্থিতি কেবল একটি ‘দৃশ্য’ নয়, বরং একটি বার্তা।
এই শিশুরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে, নীতিনির্ধারণ করবে, স্বপ্ন দেখবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে। বলা যায়, ওদের চোখেই আজকের রাজনীতির সবচেয়ে স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব দেখা যায়। তবে এই পরিবর্তন এক দিনে আসেনি। শিশুদের অংশগ্রহণ, তাদের কণ্ঠে রাজনীতির ভাষা, এগুলো সমাজে একটি ধীর পরিবর্তনের জানান দেয়। যেখানে রাজনীতি মানে কেবল দলীয় জার্সি নয়, বরং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা।
তবে এই সুন্দর রূপকে কেউ কেউ নেগেটিভ চোখেও দেখে। প্রশ্ন তোলে, ‘বাচ্চারা কি রাজনীতির জন্য?’ উত্তরটা সহজ : তারা রাজনীতি করছে না, তারা ভালোবাসা দেখাচ্ছে। তারা শিখছে, বুঝছে, জিজ্ঞেস করছে এবং এক দিন তারা সেই জ্ঞান দিয়েই সমাজ গড়বে। তাই আজ তাদের যেটুকু ভালোবাসা ও স্বীকৃতি দেওয়া যায়, সেটুকুই আগামী দিনে ফিরে আসবে।
এ জন্যই এমন দৃশ্য আমাদের আশা জাগায়। কুড়িগ্রামের পথ ধরে যখন এক দল শিশু শাপলা-শাপলা বলে ছুটে চলে, সেই শব্দ বাতাসে ভেসে নয়, গায়ে লেগে থাকে। তা এক ধরনের আশার ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়। এই দেশের বাচ্চারাও পারবে, গড়বে, বদলে দেবে। বিদেশের শিশুদের মতো আমাদের শিশুরাও যে মঞ্চে, রাজপথে, শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে নিজের স্থান করে নিতে পারে, এই দৃশ্য তারই একটি ঝলক।
দেশ গড়ার যাত্রা শুধু বড়দের একচ্ছত্র অধিকার নয়। এটা এখন সবার। আর যারা এখনো হাত ধরে হাঁটে, তারাই এক দিন কাঁধে দায়িত্ব নেবে। তাই শিশুদের অংশগ্রহণকে প্রশ্ন না করে, স্বাগতম জানানো উচিত। এই ছোট ছোট পরিবর্তনই বড় স্বপ্নের ভিত্তি।
এই শিশুদের চোখে আমরা যেন নিজেদের ফেলে আসা স্বপ্নগুলোকে আবার নতুন করে দেখি। এমন মুহূর্তে বলতেই হয়-পরিবর্তন সত্যিই আসছে। আর সেই পরিবর্তনের হাত ধরেই হাঁটছে শিশুরা।