Logo
×

Follow Us

রাজনীতি

কর্ণেল জিয়া : সেনাকর্মকর্তা থেকে গোপন রাজনীতিতে

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১১:০৩

কর্ণেল জিয়া : সেনাকর্মকর্তা থেকে গোপন রাজনীতিতে

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. জিয়াউদ্দিন (বীর-উত্তম)

গত ৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. জিয়াউদ্দিন (বীর-উত্তম)। শৈশব থেকে জিয়াউদ্দিনের যাপিত জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সে সংগ্রাম ছিল প্রথমে খিদের সঙ্গে, তারপর রণাঙ্গনে এবং রাজনীতির ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের নানা সিদ্ধান্তে হয়েছেন ক্ষুব্ধ ও হতাশ। তারপর সমাজ বদলে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে বিপ্লবের নেশায় যোগ দেন ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’তে। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর সর্বহারা পার্টির নানা বাঁক বদলে অন্যতম শীর্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রায় ১৭ বছর কাটিয়েছেন আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। সেই জিয়াউদ্দিন চলে গেলেন অনেকটা নীরবে-নিভৃতে। প্রাত-প্রদীপের আলো থেকে অনেকটা দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে।

প্রাথমকি জীবন

জিয়াউদ্দিন ১৯৩৯ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম তথা বর্তমান কক্সবাজার জেলার হারবাং ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগত সূত্রে দার্জিলিং ও দেরাদুনে অবস্থান করতেন তার বাবা। ফলে শৈশবে বাবার সান্নিধ্য খুব একটা পাননি তিনি। জিয়াউদ্দিন গ্রামে মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। তার শিক্ষাজীবনের শুরু হারবাং প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। মা-বাবার অন্তঃকলহে জিয়াউদ্দিনের শৈশব-কৈশোর মোটেই সুখকর ছিল না। এ বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ ‘লাল সন্ত্রাস : সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’ বইয়ে  জিয়াউদ্দিনের একটি লেখা উদ্ধিৃত করেছেন, ‘... আব্বা ও আম্মা প্রায়ই ঝগড়া করতেন। রাতে আমরা বালিশের নিচে মাথা গুঁজে ঘুমাতে চেষ্টা করতাম।...আমাদের জীবনটা তখন একেবারে তিক্ত হয়ে ওঠে। প্রায় সময় বাড়িতে রান্না করা হতো না। আমরা খালি পেটেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম।’

এমন পরিস্থিতিতে জিয়াউদ্দিন ঘর ছাড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ‘পাকিস্তান এয়ারফোর্স পাবলিক স্কুল সারগোদা’য় ভর্তি হন। তারপর চট্টগ্রাম কলেজ হয়ে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। একাডেমিতে আড়াই বছর কাটানোর পর অফিসার র‌্যাংক লাভ করে কুমিল্লায় বদলি হয়ে যান।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশে ফিরে যুদ্ধে যোগ দিতে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত অসংখ্য বাঙালি অফিসারের মতো ছটফট করতে থাকেন কর্নেল তাহের। পালানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন তাহের। তার সঙ্গে যুক্ত হন মেজর জিয়াউদ্দিন (পরবর্তী সময়ে কর্নেল), মেজর মঞ্জুর ও তার পরিবার, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী এবং সৈনিক আলমগীর। ২৫ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম থেকে শিয়ালকোট হয়ে জীবনবাজি রেখে ভারতে প্রবেশ করেন তারা।

ভারতে নানা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জিয়াউদ্দিন জেডফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার পদে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সক্ষম হন। জিয়াউদ্দিনের সুনিপুণ রণকৌশলে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেট অঞ্চলে মরণপণ যুদ্ধে উপনীত হয়। জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলোচিত অপারেশনগুলো হলো, ‘২১ নভেম্বরের আটগ্রাম, চারগ্রাম ও জকিগঞ্জ যুদ্ধ, ২২ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা কানাইঘাট যুদ্ধ, ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ যুদ্ধ। ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এখানে উল্লেখ্য, ধলাইয়ের যুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান জিয়াউদ্দিনের অধীনেই ছিলেন। স্বাধীনতার পর জিয়াউদ্দিনকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব বীর-উত্তমে ভূষিত করা হয়। এরপর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান।

ইন্দিরা-মুজিব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি-১৯৭২

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফরে আসেন। ১৯ মার্চ উভয় প্রধানমন্ত্রী ২৫ বছর মেয়াদি ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি নিয়ে সে সময় দেশের রাজনৈতিক মহল ও পত্রপত্রিকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।  চুক্তিগুলো ছিল :

অনুচ্ছেদ : এক

উভয় দেশ ও জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব বজায় থাকবে। একে অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে।

উভয় পক্ষ উপরে উল্লিখিত নীতিমালার ভিত্তিতে এবং সমতা ও পারস্পরিক লাভজনক নীতিগুলোর ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূণ সুপ্রতিবেশীসুলভ ও সার্বিক সহযোগিতার সম্পর্কের আরো উন্নয়ন ও জোরদার করবে।

অনুচ্ছেদ : দুই

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি সমতার নীতিতে আস্থাশীল থাকার আদর্শে পরিচালিত হয়েই উভয় পক্ষ সর্বপ্রকারের ও ধরনের উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদের নিন্দা করছে এবং তাকে চূড়ান্তভাবে ও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানোর ব্যাপারে তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কথা পুনরুল্লেখ করছে।

উভয় পক্ষ উপরোক্ত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জনগণের ন্যায়সংগত আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি সমর্থনদান করবে।

অনুচ্ছেদ : তিন

উভয় পক্ষ বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা জোরদার করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাদের আস্থার পুনরুল্লেখ করছে।

অনুচ্ছেদ : চার

উভয় দেশের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাবলি নিয়ে চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ সব স্তরে বৈঠক ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে।

অনুচ্ছেদ : পাঁচ

উভয় পক্ষ অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধাজনক ও সার্বিক সহযোগিতা জোরদার ও সম্প্রসারিত করে যাবে। উভয় দেশ সমতা ও পারস্পরিক সুবিধার নীতির ভিত্তিতে এবং সর্বাধিক সুবিধাদানের নীতি অনুযায়ী (Most favoured nation) বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রসারিত করবে।

অনুচ্ছেদ : ছয়

বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ একমত হয়েছে।

অনুচ্ছেদ : সাত

উভয় পক্ষ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে সম্পর্ক প্রসারিত করবে।

অনুচ্ছেদ : আট

দুটি দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী প্রত্যেকে মর্যাদার সঙ্গে ঘোষণা করছে যে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বা অংশগ্রহণ করবে না।

একে অন্যের ওপর আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত থাকবে এবং তাদের এলাকায় এমন কোনো কাজ করতে দেবে না যা চুক্তিকারী কোনো পক্ষের সামরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে বা কোনো পক্ষের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

অনুচ্ছেদ : নয়

উভয় পক্ষের কোনো এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে উল্লিখিত তৃতীয় পক্ষকে যেকোনো সাহায্য প্রদানে বিরত থাকবে। এ ছাড়া যেকোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার ভীতি দেখা দিলে এ ধরনের ভীতি নিশ্চিহ্ন করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উভয় পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের দেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং শান্তি স্থাপন সুনিশ্চিত করবে।

অনুচ্ছেদ : দশ

উভয় পক্ষের প্রত্যেকে মর্যাদার সঙ্গে ঘোষণা করছে যে, এই চুক্তির সঙ্গে অসামাঞ্জস্য হতে পারে এ ধরনের গোপন অথবা প্রকাশ্যে এক অথবা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের অঙ্গীকার করবে না।

অনুচ্ছেদ : এগারো

এই চুক্তি ২৫ বছর মেয়াদের জন্য স্বাক্ষরিত হলো এবং চুক্তিকারী উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

অনুচ্ছেদ : বারো

এই চুক্তির কোনো একটি অথবা একাধিক অনুচ্ছেদের বাস্তব অর্থ করবার সময় চুক্তিকারী পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সমঝোতার মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নিষ্পত্তি করতে হবে।

ক্ষুব্ধ জিয়াউদ্দিনের সর্বহারা পার্টিতে যোগদান

জিয়াউদ্দিন তখন ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন। এমনিতেই তিনি সরকারের ওপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। ইন্দিরা-মুজিবের এই চুক্তির ফলে জিয়াউদ্দিন আরো বেশি ক্ষুব্ধ হন। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় ‘হিডেন প্রাইজ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধটি ১৯৭২ সালের ২০ আগস্ট হলিডের প্রথম পাতায় ছাপা হয়।

জিয়াউদ্দিন লেখেন, ‘দেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা মর্মবেদনায় রূপান্তরিত হয়েছে। পথে বেরোলেই দেখা যায় লক্ষ্যহীন, স্বপ্নবিহীন, নিষ্প্রাণ মুখগুলো যন্ত্রের মতো চলছে। মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষ সাধারণত নতুন স্বপ্ন নিয়ে চলে এবং দেশ শূন্য থেকে উঠে দাঁড়ায়। সবকিছুর মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ থাকে এবং মানুষ তা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে। বাংলাদেশে ঘটছে ঠিক এর উল্টো। দেশটা যেন ভাগ হয়ে গেছে।...দেশ রসাতলে যাচ্ছে। এখন দরকার একতা। দরকার মর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এই মর্যাদা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ২৬ মার্চ (১৯৭১)। ‘গোপন চুক্তির’ মধ্যে হারিয়ে গেছে আমাদের মর্যাদা। যারা এটা সই করেছে, তাদের এই মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। এই অর্জন জনগণের প্রাপ্য। চুক্তির ব্যাপারটা যারা জানে, তাদের বেইমানির কথা জনগণকে বলতে হবে। এটা যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে তারা হবে জনগণের শত্রু। জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের এটা চাওয়ার অধিকার আছে।... বঙ্গবন্ধু যদি জনগণকে ভালোবাসেন, তার উচিত হবে জনগণকে জানানো। তার ভয় কী? আমরা তাকে ছাড়াই যুদ্ধ করেছি এবং জিতেছি। যদি দরকার হয়, আবার যুদ্ধ করব। কেউ আমাদের হারাতে পারবে না। আমরা ধ্বংস হতে পারি, কিন্তু পরাজিত হব না।’

এই নিবন্ধের পর জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনী ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী ছাড়ার বেশ কিছুদিন পর তিনি সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন। সর্বহারা পার্টির সঙ্গে তার পুরোনো যোগাযোগ ছিল। সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়ে সামরিক বাহিনীর সহকর্মীদের উদ্দেশে জিয়াউদ্দিন একটি খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে লেখা এই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আমি মনে করি, দেশ এখন ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের উপনিবেশ এবং দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দিল্লি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়...। সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর আমি দেশের সব রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি এবং সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকেই একমাত্র সঠিক পার্টি হিসেবে পেয়েছি। এই পার্টির তত্ত্ব, নীতি, পদ্ধতি, সক্ষমতা ও কার্যক্রম দেখে মনে হয়, এরাই আমাদের ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারবে।...আমি আপনাদের বিবেক, যুক্তি ও অনুভূতির কাছে আবেদন করছি, একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি গড়ে তোলার সংগ্রামে আমাদের পাশে দাঁড়ান।’

সর্বহারা পার্টিতে জিয়াউদ্দিন

জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর ময়মনসিংহ অঞ্চলের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।  ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে পার্টি-প্রধান সিরাজ সিকদারের কাছে অঞ্চল সংক্রান্ত বিষয়ে রিপোর্ট করতে গেলে জিয়াউদ্দিনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োগ করেন।

সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর সর্বহারা পার্টিতে চরম দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি দেখা দেয়। চুয়াত্তরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত সর্বহারা পার্টির বর্ধিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সভাপতি গ্রেপ্তার কিংবা মৃত্যুবরণ করলে রাজনৈতিক সাহায্যকারী গ্রুপের তিন সদস্য এবং সামরিক সাহায্যকারী গ্রুপের তিন সদস্য একসঙ্গে বসে পরবর্তী কর্মপন্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। সিকদারের মৃত্যুর পর জরুরি ভিত্তিতে চারজন সদস্য বৈঠকে বসতে সক্ষম হন। জিয়াউদ্দিন ও সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত থাকায় বাকি সদস্যরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। বৈঠকে ১ নম্বর সামরিক সাহায্যকারী আবদুল মতিনকে সমন্বয়ক এবং ২ নম্বর রাজনৈতিক সাহায্যকারী মাহতাবকে সহসমন্বয়ক নির্বাচন করে জিয়াউদ্দিন ও সুদত্ত বিকাশকে রেখে ছয় সদস্যের ‘অস্থায়ী সর্বোচ্চ সংস্থা’ (অসস) গঠন করা হয়। এ সময় সর্বহারা পার্টির মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা উপদল। চলতে থাকে বহিষ্কার ও খুনোখুনি। ‘অসস’-এর বিপরীতে কামাল হায়দারের (ছদ্মনাম) নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপকমণ্ডলী’(অবম)। জিয়াউদ্দিন, রানা, সুদত্ত বিকাশ, আরিফ (রইসউদ্দিন তালুকদার), মাসুদ (আমানউল্লাহ) এবং সুফির (মহসিন আলী) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার এবং মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত নেয় ‘অবম’। জিয়াউদ্দিন বেঁচে যান। এভাবে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে সর্বহারা পার্টি, এগিয়ে চলেন জিয়াউদ্দিনও।

১৯৭৬ সালের মার্চে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের এক বৈঠকে মিলিত হন অসস নেতারা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অসস বিলুপ্ত হয়। তৈরি হয় ‘অস্থায়ী পরিচালনা কমিটি’ (অপক)। কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন রইসউদ্দিন তালুকদার। সদস্য নির্বাচিত হন রানা, জিয়াউদ্দিন ও সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা। ১৯৮০ সালের ৫ থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলা পার্টির কংগ্রেসে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নাম বদলে রাখা হয় ‘বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টি’। ছয় সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক হন জিয়াউদ্দিন।

রাজনীতি থেকে অবসর

প্রায় ১৭ বছর গোপন রাজনীতিতে তৎপর জিয়াউদ্দিনকে একপর্যায়ে ক্লান্তি পেয়ে বসে। তিনি সর্বহারা পার্টিকে প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করেন। ১৯৮৯ সালে দলের অভ্যন্তরে সর্বহারা পার্টিকে প্রকাশ্যে আনার প্রস্তাব দেন। কেন্দ্রীয় কমিটি তার প্রস্তাবে সায় দেয়নি। জিয়াউদ্দিন পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রকাশ্য জীবনে ফিরে আসতে উদ্যোগী হন। এ বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ ‘লাল সন্ত্রাস’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সামরিক সচিব জেনারেল সাদিকুর রহমান চৌধুরী ছিলেন জিয়াউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জিয়াউদ্দিন তাঁকে টেলিফোন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আগ্রহ জানান। রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে তিনি জিয়াউদ্দিনকে সবুজসংকেত দেন। এরপর জিয়াউদ্দিন প্রকাশ্য হন।’

জিয়াউদ্দিন ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (সিডিএ) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। সর্বহারা পার্টি ছাড়ার পর জিয়াউদ্দিন আমৃত্যু আর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হননি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫