
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবন। ফাইল ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভোট ঘিরে প্রচারণা যত গতি পাচ্ছে, আলোচনায় ততই প্রধান ইস্যু হয়ে উঠছে সাইবার বুলিং। বিশেষ করে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো অনেকটা ‘বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট, কটূক্তি আর অপপ্রচারের ঢেউ তাদের মানসিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং ভোটের লড়াইকে করছে আরও জটিল।
ডাকসু নির্বাচনে এবার নারী প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রায় সব প্যানেল থেকেই ভোটে লড়বেন নারীরা। ভিপি পদে দুইজন, জিএস পদে একজন এবং এজিএস পদে আরও দুজন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু অংশগ্রহণ বাড়লেও বাস্তবতা ভিন্ন। তাদের লড়াই এখন শুধু ভোটের নয়, বরং মানসিক নিরাপত্তারও।
বিভিন্ন সংগঠন থেকে প্রার্থী হওয়া একাধিক নারী জানান, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এই অপপ্রচার কখনও ধর্মীয়, কখনো রাজনৈতিক, আবার কখনও ব্যক্তিগত আক্রমণের আকারে প্রকাশ পাচ্ছে।
ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে চরিত্রহননের প্রচারণা চলছে। ফেসবুক পেজে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই-মেয়েরা যেন রাজনীতিতে আসতে না পারে।”
ভিপি পদে আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, “হয়রানিটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে অনলাইনে। আর এটা নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই বেশি। আমরা যখন প্রচারণায় ব্যস্ত, তখন দেখছি ফেসবুকে বট আইডি থেকে আমাদের ছবি এডিট করে ছড়ানো হচ্ছে, শরীর নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করা হচ্ছে। এগুলো আমাদের মানসিকভাবে ভেঙে দিতে চাচ্ছে।”
শিবির সমর্থিত প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতিমা তাসনিম জুমাও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “অনলাইনে আমাকে নিয়ে অযথা কটূক্তি করা হচ্ছে। আমাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা হচ্ছে, অথচ আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। এসব অপপ্রচার শুধু কষ্টই বাড়াচ্ছে না, ভোটারদের মাঝেও বিভ্রান্তি তৈরি করছে।”
‘বট’ আক্রমণ ও অপপ্রচার
নির্বাচনে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বট আক্রমণ। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রার্থীদের ছবি বিকৃত করা, মিম বানানো ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঘটনা বাড়ছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
একজন প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এবার মনে হচ্ছে মাঠের চেয়ে অনলাইনের লড়াই বেশি। যাদের অর্থ ও প্রযুক্তি আছে, তারাই বট ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে টার্গেট করছে।”
প্রশাসনের পদক্ষেপ
পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন বিটিআরসিকে চিঠি দিয়ে কয়েকটি ফেসবুক পেজ বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছে। ইতোমধ্যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-১’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২’ এবং ‘ডিউ আপডেট’ পেজ বন্ধ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন বলেন, “আমরা কোনোভাবেই চাই না, সাইবার বুলিং বা অপপ্রচারের কারণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কমে যাক। এজন্য আমরা বিটিআরসির কাছে নির্দিষ্ট কিছু পেজ বন্ধ করার অনুরোধ করেছি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাইবার মনিটরিং সেল গঠনেরও প্রক্রিয়া শুরু করেছে।”
সাইবার বুলিং ঠেকাতে প্রার্থীদের দাবি
বিভিন্ন প্যানেল থেকে প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে বেশ কিছু দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে-
১) ডিএমপির সাইবার ইউনিটকে যুক্ত করে কার্যকর সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠন
২) অপপ্রচার চালানো পেজ ও গ্রুপের অ্যাডমিনদের পরিচয় প্রকাশ
৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে ভুয়া পেজ চালানো বন্ধ।
৪) অনলাইন বুলিংকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন আচরণবিধির লঙ্ঘন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থীর জোটের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, “আমরা একটি প্রজন্ম তৈরি করতে চাই যারা ভয়ের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু অনলাইন হয়রানি সেই ভয়কেই জিইয়ে রাখছে। আমরা চাই প্রশাসন শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিক।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকি বলেন, ডাকসু নির্বাচন শুধু ক্যাম্পাস রাজনীতির নয়, দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গেও যুক্ত। অথচ সাইবার বুলিংয়ের মতো সমস্যার কারণে নারী প্রার্থীরা যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন, তখন সেটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্যও বড় হুমকি।
৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আটটি কেন্দ্রে ভোট হবে। নির্বাচন উপলক্ষে ৭ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখবে কর্তৃপক্ষ।
চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী এবার মোট ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ভিপি পদে ৪৫ জন, জিএস পদে ১৯ জন, এজিএস পদে ২৫ জন, আর বিভিন্ন সম্পাদক ও সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বাকিরা।