বিএনপি প্রার্থীর প্রচারে গিয়ে গুলিতে খুন ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’, কে এই সরওয়ার?
বিশ্বজিৎ শর্মা
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৮
সরওয়ার হোসেন ওরফে সরওয়ার বাবলা।
কয়েক মাস আগেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে ‘সেকেন্ড লাইফ’ উপভোগ করছিলেন এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী তকমা পাওয়া মোহাম্মদ সরওয়ার হোসেন ওরফে সরওয়ার বাবলা।
গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় তার গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটে। এতে সরওয়ারের সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা দুইজন নিহত হন। সেসময় অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া সরওয়ারের প্রাণ নিভল ৭ মাস পর।
পাঁচটি খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে; গ্রেপ্তার হয়েছেন একে-৪৭ অস্ত্রসহ। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ১৯টি। শেষমেশ তার মৃত্যু হলো পিস্তলের গুলিতেই।
বুধবার সন্ধ্যায় বায়েজিদ— চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর পক্ষে নির্বাচনি গণসংযোগে গিয়েছিলেন সরওয়ার। এ সময় পেছন থেকে এসে এক যুবক তার পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে একাধিক গুলি করে।
একই ঘটনায় এরশাদ উল্লাহসহ আরও এক যুবক গুলিবিদ্ধ হন।
বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া খোন্দকারাবাদ এলাকার বাসিন্দা সরওয়ার বাবলা। বাবার দেওয়া নাম ছিল মোহাম্মদ সরওয়ার হোসেন। ডাকনাম বাবলা এবং সমাজে পরিচিতি ‘সরওয়ার বাবলা’ নামেই।
একসময় শিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিতি থাকলেও পরে যুবলীগ কর্মী এবং বেশ কিছুদিন ধরে নিজেকে বিএনপির কর্মী বলে দাবি করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক একাধিক হেভিওয়েট নেতার সঙ্গে একান্ত আলাপের ছবিও প্রচার করেন তিনি।
২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নগরের প্রবর্তক মোড়ে একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে ১১ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় আলোচনায় আসেন সরওয়ার। একই বছরের ৬ জুলাই বায়েজিদ এলাকা থেকে তাকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল ও গুলিসহ আটক করে পুলিশ।
একাধিকবার জেল খাটা সরওয়ার সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই নগরীর অনন্যা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বের হন তিনি। এরপর নিজেকে যুবদল নেতা হিসেবে দাবি করতেন, যদিও যুবদলের কোনো কমিটিতেই তার নাম ছিল না।
কয়েক মাস আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি।
বিএনপির ভোটের প্রচারে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর অংশগ্রহণ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে নগর বিএনপির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বলা হয়, “নিহত সরওয়ার বাবলা বিএনপির কেউ না। নির্বাচনি প্রচারণায় অনেকেই অংশ নিতে পারে।”
হত্যার চেষ্টা হয় আগেও
গত ৩০ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের বাকলিয়ার এক্সেস রোডে প্রাইভেটকারে গুলি করে হত্যা করা হয় বখতিয়ার হোসেন ও আবদুল্লাহ নামের দুই ব্যক্তিকে। তারা সরওয়ারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
একই গাড়িতে থাকলেও অল্পের জন্য রক্ষা পান তিনি। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের আরেক সন্ত্রাসী ‘ছোট সাজ্জাদকে’ দায়ী করা হয়। মূলত বড় ও ছোট সাজ্জাদের গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ ছিল সরওয়ারের।
পুলিশের ভাষ্য, এই ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিরা স্বীকার করেছেন— ছোট সাজ্জাদের নির্দেশেই সরওয়ারকে মারতে এই হামলা চালানো হয়।
ছোট সাজ্জাদ বিদেশে পলাতক শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলীর অনুসারী। একসময় সরওয়ারও তার অনুসারী ছিলেন। ২০১৫ সালের পর থেকে সরওয়ার তাদের কাছ থেকে সরে যান।
বারবার গ্রেপ্তার সরওয়ার
২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অস্ত্রসহ সরওয়ার ও ম্যাক্সনকে গ্রেপ্তার করে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর সরওয়ারের ডেরা থেকে একে-৪৭সহ অত্যাধুনিক একাধিক অস্ত্র উদ্ধার করার কথা জানানো হয়।
সেই মামলায় প্রায় ১০ বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জামিনে মুক্তি পেয়ে ভারত হয়ে কাতারে চলে যান।
সেখান থেকেও সরওয়ার ও ম্যাক্সন ফোনে চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি করতেন বলে অভিযোগ আছে। ওই চাঁদাবাজির টাকার ভাগভাটোয়ারা নিয়ে দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্বও তৈরি হয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাতার পুলিশ মাসখানেক কারাগারে রেখে সরওয়ারকে বাংলাদেশে এবং ম্যাক্সনকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফেরার পর সরওয়ারকে ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে তাকে বায়েজিদ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
গ্রেপ্তারের পরদিন সরওয়ারের আস্তানা থেকে পুলিশ একে-২২ রাইফেলসহ একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি–কার্তুজ উদ্ধার করে।
২০২২ সালের নভেম্বরে ভারতের দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুর থেকে পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ম্যাক্সনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
২০২৩ সালে একাধিক মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন সরওয়ার। পরে ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই নগরীর অনন্যা আবাসিক এলাকা থেকে আবার গ্রেপ্তার হন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জামিন পাওয়ার পর আর কারাগারে যেতে হয়নি তাকে।
কখনও শিবির, কখনও যুবলীগ, কখনও যুবদল
সরওয়ারের পরিচিতি গড়ে ওঠে শিবির ক্যাডার হিসেবে। একাধিক মামলাও হয় তার বিরুদ্ধে। সেসব মামলায় জেল থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন তিনি। যুবলীগের পক্ষে পোস্টার ছাপিয়ে এলাকায় প্রচারও চালান।
বেশ কয়েক বছর ধরেই যুবলীগের মিছিল–সমাবেশে সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল তাকে। নগরীর হাজীরপুলের পশ্চিমে ইলিয়াছ কলোনিতে সরওয়ার ও তার ভাই আজিজের অফিসে শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা ও নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি টাঙাতেও দেখা যায়।
এসময় চট্টগ্রামের একাধিক কাউন্সিলরের হয়ে নানা কাজ ও জমি দখলেও তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। এক কাউন্সিলরের সহযোগিতায় ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জেলে গিয়ে বিএনপির এক নেতার সাথে সখ্যতা বাড়ে সরওয়ারের। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নিজেকে যুবদল নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি।
কয়েক মাস আগে সরওয়ারের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন নগর বিএনপির সভাপতি ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. আসলাম চৌধুরীসহ একাধিক নেতা।
যদিও সরওয়ার বিএনপির কেউ নন— দাবি করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন,
“জনসংযোগে শত শত লোক অংশ নেয়। সন্ত্রাসী দুইটি গ্রুপের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে নিহতের ঘটনা ঘটে। এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।”
