Logo
×

Follow Us

রাজনীতি

বিগত শাসনামলে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন: সালাহউদ্দিন

Icon

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:০৭

বিগত শাসনামলে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন: সালাহউদ্দিন

ঢা‌বি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষার রূপান্তর: একটি কৌশলগত রোডম্যাপ’ শীর্ষক সেমিনার।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী, লেখক ও মিডিয়া কর্মী ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢা‌বি) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভবনে বাংলা‌দেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্ব‌াসী ঢা‌বি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষার রূপান্তর: একটি কৌশলগত রোডম্যাপ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।

সালাহউদ্দিন ব‌লেন, “রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও ভিনদেশি রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থেকে বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তায়ন’ ঘটেছে। দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী দীর্ঘদিন ধরে ‘ভারত-নির্ভর বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন, যা দেশের স্বাধীন বুদ্ধিচর্চা ও সমালোচনামূলক চিন্তাকে ক্ষয় করেছে। যেসব বুদ্ধিজীবীর অতীতে রাষ্ট্রীয় অন্যায়, নাগরিক নিপীড়ন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলার কথা ছিল, তারাই ভারতপন্থী রাজনৈতিক বয়ানের সুবিধাভোগী হয়ে নীরব থেকেছেন।”

দেশের বর্তমান শিক্ষা ও বুদ্ধিজীবী পরিস্থিতির সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের তুলনা করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্রিটিশরা তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করতে যেমন শিক্ষিত সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করত, তেমনি বিগত সময়েও কিছু বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া রাষ্ট্রের হেজিমনি (আধিপত্য) বজায় রাখতে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা সীমিত করেছিল। ফলে গণতান্ত্রিক ও সৃজনশীল চেতনার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।”

ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য আধুনিক যুগের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস, ডেটা সায়েন্স ও বায়োটেকনোলজির মতো ক্ষেত্রে মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু চাকরি তৈরি করবে না; বরং গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্র হবে।”

তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ভোকেশনাল শিক্ষা এবং পরবর্তী ধাপে জ্ঞানভিত্তিক ও গবেষণামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।

জুলাই সনদ ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রসঙ্গে বলেন, “জাতীয় ঐক্যমত্যের নামে অনৈক্য তৈরির চেষ্টা হয়েছে। তবে আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিষয়টিকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। জাতীয় সার্বভৌমত্বকে কখনো কোনো আদেশ দিয়ে তো বাধ্য করা যায় না। কারণ দেশের সর্বোচ্চ সার্বভৌমত্ব হলো জাতীয় সংসদ। মানুষ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। জুলাই সনদে গণভোট নিয়ে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছে তাতে মনে হয় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা লোকেরাও সেটি পড়তে অনেক সময় লাগবে। যাহোক দেশে একটি আদেশ জারি হয়েছে। দেশে আদেশ জারির কোনো ইতিহাসও নেই এবং এ ধরনের আদেশের ভবিষ্যৎ নেই। এ বিষয়ে সাংবিধানিক আইনী বৈধতা নেই। এদের (সরকার) উদ্দেশ্যে হলো- একটি লিগ্যাল কেওয়াজ তৈরি করা।”

নির্বাচন প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “শেষ পর্যন্ত সবাইকে জনগণের কাছে যেতে হবে নির্বাচনের জন্য। কারণ আমরা গত ১৫/১৬ বছর আন্দোলন করেছি একটি  সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। দেশের মানুষ ভোটের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একটি জাতি ও দেশ তৈরি করতে হবে যাতে কোনো ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের উত্থান না ঘটে। স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তবে স্বৈরাচারের দোসরদের বহাল রেখে স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্ভব নয়।”

তিনি বলেন, “দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতি গঠনে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। ৩১ দফা রুপরেখা সেটিরই উদ্যোগ। আমরা একটি যুগোপযোগী উদ্যোগ নেব। দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুকেই পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।”

শিক্ষা সংস্কার কমিশন না হওয়ায় সভাপতির বক্তব্যে সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করেনি, যা হতাশাজনক।”

বিএনপি ক্ষমতায় এলে শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফায় কারিগরি ও গবেষণানির্ভর শিক্ষার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত দুই বছর ধরে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে এসব পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসা নয়, দেশ গঠনের মনোভাব নিয়েই তা বাস্তবায়ন করা হবে।”

মোর্শেদ হাসান খান ব‌লেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত দুই বছর ধরে প্রতিটি সেক্টরে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে গভীর ব্যাকগ্রাউন্ড ও গ্রাউন্ড ওয়ার্ক তৈরি করেছেন। ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসা বা বিভাজন নয়- দেশ গঠনের মনোভাব নিয়েই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে।”

শিক্ষায় কাঠামোগত দুর্বলতা ও ব্রেইন ড্রেন এর বিষয়ে উল্লেখ করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এ বি এম ওবাইদুল ইসলাম বলেন, “প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা- সব স্তরেই মৌলিক দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা আনন্দদায়ক না হয়ে বোঝায় পরিণত হয়েছে। আর ল্যাবরেটরিতে যন্ত্রপাতির অভাব ও তহবিলের সংকটে মানসম্মত গবেষণা হচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ নেই। ‘ব্রেইন ড্রেন’ রোধে দক্ষ জনশক্তিকে দেশে ফেরানোর কথা বলা হলেও পরিবেশ তৈরি হয়নি। শুধু সিলেবাস পরিবর্তন নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর করে জাতিসংঘের নীতির মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবমুখী শিক্ষা চালু করা জরুরি।”

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ। 

তি‌নি ব‌লেন, “বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর্তি বৃদ্ধি, নারীদের শিক্ষায় অগ্রগতি এবং বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের মতো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও এখনো গুণগত মান, অবকাঠামো, শিক্ষকঘাটতি, প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা এবং উচ্চ শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। দ্রুত পরিবর্তিত প্রযুক্তি, শ্রমবাজার এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার কৌশলগত রূপান্তর অপরিহার্য।”

তিনি বলেন, “শিক্ষায় নারীদের অগ্রগতি ও ভর্তির হার বাড়লেও গুণগত মান ও অবকাঠামোগত ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ। আধুনিক শ্রমবাজার ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শিক্ষাব্যবস্থার কৌশলগত রূপান্তর অপরিহার্য। এই রূপান্তরের ভিত্তি হিসেবে 4P কাঠামো- পারপাজ, পলিসি, প্রোগ্রাম এবং প্রাক্টস ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও দর্শন পরিষ্কার করা, প্রশাসনিক ও নীতিগত সংস্কার, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ এবং মাঠ পর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একটি শক্তিশালী ও টেকসই শিক্ষা রোডম্যাপ শিক্ষাকে আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক মূল্যবোধসমৃদ্ধ করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ ও প্রতিযোগিতায় সক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।”

স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক মহিউদ্দিন বলেন, “ভুল নীতি ও ব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, যার ফলে দেশে ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যৎ শিক্ষা হতে হবে কর্মমুখী ও যুগোপযোগী।”

সেমিনারে সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুল সালামের সঞ্চালনায় এ সময় উপস্থিত ছিলেন সেমিনার আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমএ কাউসার ও সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান, ঢাবির কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুল্লাহ, ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান বিশ্বাস, অধ্যাপক আতাউর রহমান মিয়াজী, ড. মো. নূরুল আমিন, চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় দে রিপন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম ও অধ্যাপক জাফর আহমেদ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মো. শামীম, অধ্যাপক ড. আবদুল করিম, অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ, অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ছবিরুল ইসলাম হাওলাদার, শাবিপ্রবির অধ্যাপক খায়রুল ইসলামসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসি, কোষাধ্যক্ষ ও ঢাবির প্রক্টরিয়াল টিম এবং বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন হলের প্রভোস্টবৃন্দ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫