
ছবি: গুগল থেকে নেয়া
দুনিয়া কাঁপছে করোনাভাইরাসে। প্রকৃতি পরীক্ষা নিচ্ছে মানুষের। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এই ঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে মার্চে। প্রতিদিনই আক্রান্ত আর মৃত্যুর পুরনো রেকর্ডকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নতুন সংখ্যা।
এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার ও সাধারণ মানুষও। সাধারণ ছুটি, স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি নানা বিধিনিষেধ ও করোনাভাইরাসের প্রভাবে কর্মহীন হয়েছেন অসংখ্য মানুষ।
প্রশ্ন উঠেছে এরকম নানা পরিস্থিতি সামলে জীবন-জীবিকা নির্বাহ যখন কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন কোথায় জনপ্রতিনিধিরা?
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রাথমিক পদক্ষেপে গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা ও শারীরিক দূরত্ব মানতে সরকারি ঘোষণার পর কার্যত জনগণের কাছ থেকে আরো দূরে চলে গেছেন অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি।
তবে এই সময়েও কিছু জনপ্রতিনিধি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সক্রিয়তার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারী তাদের মধ্যে অন্যতম।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ সংসদ সদস্যের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ডও বিরক্ত। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নির্দেশনা দেয়ার পরও মানুষের পাশে না দাঁড়ানোয় অসন্তুষ্ট দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব। ভবিষ্যতে দলের বা সরকারের কোনো দায়িত্ব ও মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে এই করোনাকালের নিষ্ক্রিয়তাকে আমলে নিয়েই দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে মনে করেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
তারা বলেন, দলের কোনো সংসদ সদস্য এই সময়ে কী ভূমিকা রেখেছেন তার খতিয়ান রয়েছে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার কাছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধির বিষয়েও তিনি নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছেন।
সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তার খতিয়ান
বারবার নির্দেশনা দেয়ার পরও কোনো কোনো সংসদ সদস্য নিষ্ক্রিয় থেকেছেন আর কারা ছিলেন সক্রিয়; তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তার নির্দেশেই মে মাসের শুরুর দিকে এমপিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এই প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১২০ এমপি তার নির্দেশ পালনে সক্রিয় বলে উল্লেখ রয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি মণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য।
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এমপিদের বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে মনোনয়ন পাওয়া। এছাড়া সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও দুই-তিনবার নির্বাচিত কয়েকজন সাংসদও স্থানীয় জনগণের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তথ্যমতে, বর্তমান একাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারীসহ ৩৫০ সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২২৫ জনই স্থানীয়দের পাশে দাঁড়াননি। করোনাকালীন এ সময়ে তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। বাকি ১২৫ সাংসদ নিজ নিজ এলাকার জনগণের পাশে থেকে কাজ করছেন।
সংরক্ষিত নারী আসনসহ আওয়ামী লীগের সদস্য রয়েছেন ২৯৬ জন। তাদের মধ্যে এ দুর্যোগে মাঠে সক্রিয় মাত্র ১২০ জন। অন্যান্য দলের মাত্র পাঁচজন এমপি দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে।
একাদশ সংসদে ৩৫০ সাংসদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্য ২৫৩ জন। আর দলটির সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য রয়েছে ৪৩ জন। জাতীয় পার্টির সদস্য আছেন ২২ জন। আর দলটির সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য চারজন। বিএনপির একজন সংরক্ষিতসহ রয়েছেন সাত সদস্য। ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্য তিন আর সংরক্ষিত নারী সদস্য একজন। জাসদ, বিকল্পধারা ও গণফোরামের দু’জন করে এবং তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টির (জেপি) একজন করে সদস্য রয়েছেন। এছাড়া একজন সংরক্ষিতসহ স্বতন্ত্র এমপি আছেন তিনজন।
যে কারণে এমপিদের বাদ দিয়ে সচিবরা তদারকিতে
গত ২০ এপ্রিল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির জন্য ৬৪ জন সচিবকে ৬৪ জেলা তদারকির দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক জরুরি আদেশে এই দায়িত্ব দেয়া হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক কর্মীরা মনে করেন, এমপিদের কাজে আস্থা না রাখতে পেরেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন
দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসন নিশ্চিতে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন বিপদে রাজনৈতিক কর্মীরা বা জনপ্রতিনিধিরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে দূরে সরে যাওয়ার এই প্রবণতাকে তারা স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। তাদের মতে, যেহেতু সমসাময়িক নির্বাচনী বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের ভোটকে তোয়াক্কা করতে হয় না রাজনীতিকদের, সেহেতু এই দুর্যোগের সময় ‘নিরাপদ দূরত্বে’ থাকাকেই তারা শ্রেয় মনে করবেন।
সুশানের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনীতি ও জনসেবা একসময় একে অপরের পরিপূরক থাকলেও এখন দুটির পথ ভিন্ন। রাজনীতি এখন একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে দলীয় পদ-পদবি পাওয়ার পুরো বিষয়টিই এখন আর্থিক বিনোয়োগের মাধ্যমে বিবেচনা করা হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভবিষ্যতে সব নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধিদের মূল্যায়নের কোনো সুযোগ তৈরি হলে সাধারণ মানুষ করোনাকালের এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বেশিরভাগ রাজনীতিক বা জনপ্রতিনিধি এখন তাদের কর্মকাণ্ডকে দেখেন ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে; কারণ বর্তমানে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিক্য অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের চেয়ে আমলারাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন।’
ব্যবসায়ী নির্ভর হয়ে পড়ছে রাজনীতি- এ কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
পেছন ফিরে দেখা
যে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন এই সংসদ সদস্যরা সেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের মহাবিজয়ের পর ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৮৮টি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৬০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জয়ী হয়েছে ২৫৭টিতে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে পাওয়া ফল অনুযায়ী, মহাজোট প্রদত্ত ভোটের ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে। নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের ১১০ জনই পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৯০ শতাংশের বেশি ভোট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বিপুল জয়ের পর করোনাকালে যেখানে মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার, সেখানে জনগণ থেকে আক্ষরিক অর্থেই ‘সামাজিক দূরত্বে’ রয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা!