Logo
×

Follow Us

রাজনীতি

ফের ভাঙনের মুখে ওয়ার্কার্স পার্টি

Icon

আদম মালেক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:৪৩

ফের ভাঙনের মুখে ওয়ার্কার্স পার্টি

তুষের আগুনের মতো পুড়ছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। আসন্ন কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে নেতা-কর্মীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। দলের সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান পলিটব্যুরোর সদস্য বিমল বিশ্বাস। আসন্ন কংগ্রেস স্বচ্ছ না হলে পদত্যাগ করতে পারেন আরও অনেকেই। অবস্থাদৃষ্টে ওয়ার্কার্স পার্টি ফের ভাঙনের মুখে পড়ছে বলে আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা।

পদত্যাগী নেতা বিমল বিশ্বাস ‘শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার’ ডাক দিয়েছেন। তার মতে, ‘ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান নেতৃত্বে কোনো আদর্শিক রাজনীতির চর্চা সম্ভব নয়। তাই যারা মার্ক্সবাদের সঠিক চর্চা করেন, তাদের নিয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এ কাজ সহজ নয়, অনেক অমসৃণ ও বন্ধুর। তাই জেনে-শুনে এগোতে হবে। নজরে রাখতে হবে ওয়ার্কার্স পার্টির ভেতর ক্ষুব্ধ আদর্শবাদী নেতা-কর্মীদের তৎপরতার দিকে।’ 

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ওয়ার্কার্স পার্টি আজ গণতন্ত্রহীন। নেই মার্ক্সবাদের চর্চা। তাই দলের অনেক নেতা-কর্মী পার্টি থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অনেকে পার্টি অফিসে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত ছাত্র মৈত্রীর কোনো কোনো সাধারণ সম্পাদক সদস্য পদ নবায়ন করলেও কোনো সভাপতি সদস্য পদ নবায়ন করেননি। এভাবে অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যারা মার্ক্সবাদী আদর্শেই বিশ্বাসী নয়, তাদেরও দলের সদস্য পদ প্রদান করা হয়েছে।

ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘এই ওয়ার্কার্স পার্টিতে আমি আর নেই। যেখানে আদর্শের চর্চা নেই, সেখানে থাকার কোনো অর্থ নেই। তাই এবার পার্টির সদস্য পদ নবায়ন করিনি। আমার মতো অনেকেই পার্টির সদস্য পদ নবায়ন করেননি।’

বিমল বিশ্বাস বলেন, ‘বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্র্টির মূল নেতৃত্ব মুখে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের কথা বললেও কাজ করেন সেই আদর্শের বিরুদ্ধে। এই কারণে আমি পার্টি ছেড়েছি।’ পদত্যাগপত্রে তিনি বলেছেন, ‘কৌশলের নামে ওয়ার্কাস পার্টি তার নীতিকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলগত যে ঐক্য, তাকে কাজে লাগানো হয়েছে এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার জন্য। লুটেরা ধনিক শ্রেণির যে কোনো দলই সমাজ বিপ্লবকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মূলগতভাবেই শত্রু।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওয়ার্কার্স পার্টির গঠনতন্ত্রে বর্ণিত সদস্যপদের ধারাগুলোকে পদদলিত করে এবার ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী জেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় সদস্য বৃদ্ধির নামে যাকে তাকে সদস্যপদ দিয়ে পার্টির শক্তি বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। পার্টি ও শ্রেণি গণসংগঠনের আন্তঃসম্পর্ক, ফান্ড পলিসি, ক্যাডার পলিসিসহ অনেক ব্যাপারেই মতপার্থক্য রয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘দলে অভিযোগ ও ভিন্নমত স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টিতে এসব অভিমত আসে। একটি দলের মধ্যে অসংখ্য অভিমত থাকে। এসব ভিন্নমত নিয়ে পার্টির সর্বত্র আলোচনা হয়েছে। এসব অভিমত পর্যালোচনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে।’ 

পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ বলেছেন, ‘রাশেদ খান মেনন নির্বাচন নিয়ে সরকারবিরোধী বক্তৃতা দিয়ে পরদিন তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এটা ইউটার্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। এ আচরণ অনুচিত ও অনাকাংঙ্খিত।’ তা ছাড়া দলের মধ্যে ভিন্নমত প্রচার নিয়ে মেননের দাবি প্রসঙ্গে জাহিদ বলেন, ‘কর্মীদের অভিযোগ, সারাদেশে সঠিকভাবে ভিন্নমত প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন জেলায় নতুন সদস্য তৈরি করা হচ্ছে। গঠনতন্ত্রের নিয়মকানুন ভঙ্গ করে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো গণ সদস্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার অপকৌশল নেওয়া হয়েছে। রাজশাহী, ঢাকা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ কাজ সুকৌশলে সম্পাদন করা হয়েছে।’ 

ভিন্নমতের সঙ্গে যুক্ত নেতারা জানান, ইতিমধ্যে দশম কংগ্রেসকে সামনে রেখে সারাদেশে কমিটি হচ্ছে। এসব কমিটি গঠনে কেন্দ্রের প্রভাবে ভিন্নমতকে এড়িয়ে যাওয়ার সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বগুড়া, মাদারীপুর, পিরোজপুরে ইতিমধ্যে স্থানীয় নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বগুড়া জেলার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সালেহা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের বগুড়ায় পুরনো সদস্য ছিল ১১৩ জন। এবার জেলার সাধারণ সম্পাদক ঘরে বসেই আরও ৪০ জনের ফরম পূরণ করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন এবং এটা গৃহীতও হয়েছে। এভাবে রাজশাহীতে যেখানে ২০০ জন পুরনো সদস্য ছিল, সেখানে নতুন করে ১ হাজার ১০০ সদস্য যুক্ত করা হয়েছে। বগুড়ায় যাদের সদস্য করা হয়েছে, তাদের কখনো দলীয় কর্মসূচিতে দেখিনি।’

পার্টিতে কেন এই অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে, বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ওয়ার্কার্স পার্টির নারী মুক্তি সংসদের এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করে এসেছি পার্টি দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে না। আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছিল। বিশেষ করে জোটের নৌকা গ্রহণ করা, প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন না তোলা, সরকারে অংশগ্রহণ করার বিষয়গুলো মার্ক্সবাদী আদর্শের ভিত্তিতে ঘটেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে পার্টি ভেঙেই যাবে।’

পলিটব্যুরোর একাধিক সদস্য মনে করছেন, কংগ্রেসকে সামনে রেখে রাশেদ খান মেননপন্থীরা ভিন্নমত পোষণকারীদের কোণঠাসা করলে দল নিশ্চিত ভাঙনের মুখে পড়বে। এ প্রসঙ্গে পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘আদর্শিক, রণনীতির শত্রু যারা, তাদের সঙ্গে ঐক্য করা, আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করা ছাড়াও সরকারে অংশগ্রহণ নিয়ে দলের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা নৌকা প্রতীক ব্যবহার করতে চাই না, সরকারে অংশগ্রহণ করতে চাই না।’

দল ভাঙা বা না ভাঙার বিষয়ে ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘সংশয় তৈরি হচ্ছে কংগ্রেস বৈধ প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হবে কি না। ইতিামধ্যে পার্টিতে এ প্রশ্ন উঠেছে- কংগ্রেস প্রহসনে পরিণত হবে। এই টানাপড়েন এখন দলে চলছে। ফলে, কংগ্রেস কীভাবে আয়োজন হবে, এর ওপর নির্ভর করছে দলের ভবিষ্যৎ।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউনাইডেট কমিউনিস্ট লীগ ও সাম্যবাদী দল (আলী আব্বাস) এই তিনটি দল নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৯৯৫ সালে পলিটব্যুরোর সদস্য টিপু বিশ্বাস বেরিয়ে ‘গণফ্রন্ট’ নামে নতুন দল করেন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন বেরিয়ে যান পলিটব্যুরোর আরেক সদস্য সাইফুল হক, বর্তমানে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টি তৃতীয় দফায় ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পার্টির একাধিক নেতা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫