Logo
×

Follow Us

রাজনীতি

ফিরে দেখা ২০২০

বছরজুড়ে উত্তাপহীন রাজনীতি করোনাভাইরাসে ঘরবন্দি

Icon

হামিদ সরকার

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২১, ১২:৫৮

বছরজুড়ে উত্তাপহীন রাজনীতি করোনাভাইরাসে ঘরবন্দি

গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ফাঁকা ভোটকেন্দ্র। ফাইল ছবি

বিরোধীদলহীন রাজনীতি সব সময়ই উত্তাপহীন। আর সেই পরিবেশ বাংলাদেশে বিরাজ করছে দীর্ঘ সময় ধরে। সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিরোধী রাজনীতি উত্তাপ ছড়ানো তো দূরে থাক, মাঠেই আসতে পারছে না। ২০২০ সালের শুরুতেই বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির দাবি ছিল দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি। এরই মধ্যে মার্চে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সেই রাজনীতিকে ঘরে তুলেছে। জীবন থেকে মৃত্যু, আর রাজনীতিকে লণ্ডভণ্ড করেছে এই কভিড-১৯।

মার্চে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে নির্বাহী আদেশে বেশ কিছু শর্তে জামিনে মুক্তি পান বেগম খালেদা জিয়া। বছরজুড়েই রাজনীতির মাঠের চেহারা ছিল অপরিচিত। ছিল না মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, বা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি। সবাই নিজের ও পরিবারের জীবন রক্ষা নিয়েই চিন্তিত। ডিজিটালে টুকটাক বিবৃতি দিয়ে শীর্ষ নেতারা নিজেদের কিছুটা ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতেন। ডিজিটাল মাধ্যমনির্ভর এখন দেশের রাজনীতি। করোনাভাইরাসের মাঝে নির্বাচন কমিশন কয়েকটি উপ-নির্বাচন দিয়েও রাজনীতিকে মাঠে আনতে পারেনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা এখন বেশ চরমে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারি দলের ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানে বিতর্কিত ব্যক্তিদের অপরাধ জনগণের সামনে প্রকাশ পায়। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতিবাজ নেতাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ায়, বিশেষ করে যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে দলের অনেক নেতাকর্মী চুপ হয়ে যায়। অনেকেই আবার গা-ঢাকা দিয়ে আছে। যুবলীগের শীর্ষ দুই নেতা নির্ধারণ করিয়ে দিয়ে কমিটি অনেক দিন পর নতুন করে ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় বিদায়ী বছরের রাজনীতি ছিল অন্যরকম, ভিন্নমাত্রার।

করোনাভাইরাস দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন ধরনের পরিবর্তন এনেছে। রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে দিয়েছে। অনেক কিছু নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে। কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন চলতে হবে, তার শিক্ষা দিয়েছে। এ সময়ে কীভাবে রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠন পরিচালনা করতে হবে, তার কর্মকৌশলও চিন্তা করতে হবে নতুন করে।

এদিকে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বললেও দৃশ্যমান কিছু করতে না পারেনি বিএনপি। তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠন হলেও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অভ্যন্তরে নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের খবর মাঝে মধ্যেই আসছে। বিএনপিতে কি নতুন করে আবার কোনো ঝড়ের আলামত দেখা যাচ্ছে? ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে দলটি কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারছে না, গোছাতে পারছে না মাঠ পর্যায়ের দলীয় সংগঠন। সৃষ্টির পর থেকে দলটি এ পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক নেতা সরে গেছেন। সংকট মোকাবেলায় বিএনপির নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেও দলটির মধ্যেই অনেক বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে এই মহামারিকালেই। দলটির নেতৃত্বের জীর্ণদশা সামনে চলে আসে এ সময়ে। বছরের শেষভাগে দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে শোকজ নোটিস দেওয়া হয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। 

দলীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে গত ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ ও সাংবাদিক শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানো নোটিস দেয় বিএনপি। এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর শওকত মাহমুদ পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার জবাব দেন। ‘জ্ঞাতসারে দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো কাজ করেননি’ বলে শওকত মাহমুদ তার এক পৃষ্ঠার জবাবে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি মেজর হাফিজউদ্দিন বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ার কাছে তার বক্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি পাঁচ পৃষ্ঠার জবাবটি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপনের অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপি নেতৃত্বের কাছে। সেখানে তার বিরুদ্ধে যে ১১টি অভিযোগ আনা হয়, সেগুলো ‘সঠিক নয়’ দাবি করে তা খণ্ডন করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘দলে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করতে একটি মহল সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’ তবে কারণ দর্শানো চিঠির (শোকজ) জবাব দিলেও, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি।

বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’। ভাইস চেয়ারম্যান পদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে দলে শীর্ষ নীতি-নির্ধারণী স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা- এমনই মন্তব্য কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের। নেতাদের কারো মন্তব্য, ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয়কে শোকজ করায় দলের নেতা-কর্মীদের ভেতরে ‘বিরূপ প্রতিক্রিয়া’ সৃষ্টি হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির অনেক সদস্যই এরকম অ্যাকশনের কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এটি দলের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টির একটি আলামত বলে মনে করছেন তারা। তবে দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, উনারা জবাব দিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ আছেন, এটি নিয়ে তারা পরে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এদিকে, দুই দলেরই জোটের রাজনীতি এখন তেমন নেই। তবে বিএনপির জোটের অবস্থা বেশ নাজুক। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট থেকে কয়েকটি দল ছুটে যায় সরকারি দলের কাছাকাছি। নানা জটিলতায় বিএনপি বলতে গেলে জোট গঠনের আগে যেমন একলা ছিল, তেমন অবস্থায় চলে এসেছে। জোট ছাড়াই এখন বিভিন্ন উপ-নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে নিজেদের মতো করে। তবে এই নির্বাচনগুলোতে অংশ নেওয়ার জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে আগেই অনেক চাপ ছিল; কিন্তু জোটের কারণে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। এখনো মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে শীর্ষ নেতাদের সক্রিয়তা নিয়ে অনেক ক্ষোভ ও প্রশ্ন। আবার মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়েও অনেক ক্ষোভ বিরাজ করছে। মামলার আসামি হয়ে মাঠে থেকেও অনেককেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও উপ-নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পাওয়াটা দলে বিমাতাসুলভ আচরণ বলে তারা মনে করছেন। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছিল। তারা সর্বশক্তি বিনিয়োগ করেছিল ওই নির্বাচনে; কিন্তু সরকারি দলের কাছে পরাজয়ে তারা প্রচণ্ডভাবে আহত। মনোবল ভেঙে যায় কর্মীদের। একটি জয় পেলেও তারা উজ্জীবিত হতো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাকালীন অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে দল পরিচালনার চিরচেনা কৌশল বদলে নতুন করে ভাবতে হবে। বিশ্ব রাজনীতির চিত্রই এখন পাল্টে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে আগামী দিনের রাজনীতিকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে দলগুলোকে পরিচালিত হতে হবে। বিএনপির ক্ষেত্রে দলের ভেতরে যে ক্ষোভ ও দূরত্ব আছে তা কাটাতে না পারলে সামনের রাজনীতির পথচলা তাদের জন্য বড়ই কঠিন হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫