Logo
×

Follow Us

রাজনীতি

হেফাজতের ক্ষমতার শেকড় কোথায়?

Icon

জাকারিয়া পলাশ

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২১, ০৯:০০

হেফাজতের ক্ষমতার শেকড় কোথায়?

ফাইল ছবি

সমসাময়িক বাংলাদেশে আলোচিত এক শক্তির নাম হেফাজতে ইসলাম। সামাজিক মাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কেউ মনে করে দেশের এক ‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’ এরা। আবার কেউ এদের দেখছেন এক ‘অরাজনৈতিক আন্দোলন’ হিসেবে। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক মাপকাঠিতে এই গোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ করা জরুরি। পাশাপাশি এদের ক্ষমতার-অক্ষমতার সীমা-পরিসীমা কতটুকু তাও অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করা প্রয়োজন। 

হেফাজতে ইসলামের পরিচয় স্মরণ করলে অনেকেরই মনে পড়ে, ২০১৩ সালে মতিঝিল শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশের কথা। শাহবাগের গণজাগরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তখন শাপলা চত্ত্বরের পাল্টা মহাজমায়েত হয়েছিল বলেই, শাহবাগ-শাপলা শব্দযুগলকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রতিচ্ছবি বলে মনে করা হয়। ১৯৭১-এ সংঘটিত যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের ‘ফাঁসির’ দাবিতে শাহবাগ জমে উঠলেও মূলত সেটি ছিল বাংলাদেশের ‘সেক্যুলারায়নের’ পক্ষে শহুরে মধ্যবিত্তের দাবির প্রতিফলন। তারই বিপরীতে শাপলা চত্বরে যে হেফাজতের বিস্ফোরণ হয়েছিল তাকে বাংলাদেশের ‘সেক্যুলারায়ন বিরোধী’ তথা ‘ইসলামীকরণের’ দাবির পুনর্জাগরণ বলা যায়। 

তবে হেফাজতের উত্থানকে কেবল ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের একটা হঠাৎ প্রতিক্রিয়া ভাবলে যথার্থ হবে না। ২০১৩ সালে শাহবাগের প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক আমার দেশ, ইনকিলাব ইত্যাদি প্রচারমাধ্যম ও মাহমুদুর রহমান, ফরহাদ মজহার, প্রয়াত অধ্যাপক পিয়াস করিম প্রমুখের তত্ত্বাবধানে শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ধর্মবিদ্বেষের অভিযোগ আনা হয়েছিল। মূলত সেখান থেকেই হেফাজতের উত্থান; তার জবাবে হেফাজতে ইসলাম ব্যানারে ১২টি ইসলামী সংগঠনের যৌথ কর্মসূচিতে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।

এসব দাবির মধ্যে ছিল- সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন করা, ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা, নারী নীতি ও শিক্ষা নীতির কথিত ‘ইসলামবিরোধী’ ধারাগুলো বাদ দেওয়া, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, ভাস্কর্য বা মঙ্গল প্রদীপের মতো বিষয়গুলোর বিরোধিতা, ধর্মীয় কাজে ও প্রচারে বাধা-নিষেধ আরোপ বন্ধ করা, নাটক সিনেমায় ধর্মীয় পোশাকধারী ব্যক্তিকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে দেখানো বন্ধ করা, এনজিও ও খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার মতো বিষয়গুলো। পরে ওই দাবিতে ৫ মে মতিঝিলের সমাবেশ হয়। একে হেফাজতে ইসলামের ‘বিস্ফোরণ পর্ব’ বলা যায়। তবে এর উত্থানপর্ব আরও অনেক পেছনে। 

গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে বিভিন্ন ব্লগ বা উন্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইসলামের নানা দিক নিয়ে কটূক্তি ও সমালোচনা বিস্তার লাভ করেছিল। সে সময় এসব ‘ইসলামবিরোধী’ কাজের বিরোধিতার ও প্রতিরোধের জন্য আলেম সমাজকে একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে আনার লক্ষ্যে এই হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার প্রধান আহমদ শফীকে এর প্রধান করা হয়েছিল। মূলত ভারতের দেওবন্দভিত্তিক কওমি মাদ্রাসাগুলোর আলেমরা এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছিলেন। এরা ২০১১ সালে প্রণীত জাতীয় নারী নীতিকে ইসলামবিরোধী উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে হরতাল ও বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি দিয়েছিল। তবে এরও আগে হেফাজতে ইসলাম গঠিত না হলেও কওমি ঘরানার এ আলেমরা নানা ইস্যুতে আন্দোলন করেছিলেন। 

প্রশ্ন হলো, হেফাজতে ইসলামের এই প্রভাবের নেপথ্য কী? হেফাজত নেতাদের বক্তৃতায় প্রায়ই একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। তাহলো, ‘৯০ শতাংশ মুসলমানের বাংলাদেশ’। এই পরিসংখ্যানটিই বড় দাগে চিহ্নিত করে দেয় যে, তারা এদেশের মুসলিম জনসংখ্যাকেই তাদের মূল সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে চিন্তা করে। এছাড়া ধর্মীয় পরিচয় তাদের বাংলাদেশের বাইরেও ‘বিশ্ব মুসলিম’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’র সঙ্গেও যুক্ত করে দেয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে শত কোটি মানুষের পক্ষের লোক বলে দাঁড় করায়। পক্ষ-বিপক্ষের এই বিরাট পরিসংখ্যান এদের বয়ান ও ভূমিকা নিরূপণ করতে সাহায্য করে। 

হেফাজতের প্রতি আরেকটি বড় সমর্থক গোষ্ঠীর কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার। উদার, গণতান্ত্রিক এবং মানবতাবাদী একটি অংশ হেফাজতের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই শ্রেণি হেফাজতকে দেখে থাকেন দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে। তারা মনে করে, হেফাজত কর্মীরা মূলত এতিম-মিসকিন শ্রেণি, উচ্চবিত্তের দান-খয়রাতের ওপর নির্ভরশীল, উৎপাদনমুখী অর্থনীতিতে প্রায় অনুৎপাদনশীল। কাজেই কেবল বিরোধিতা না করে সমাজ ও অর্থনীতির মূলধারায় তাদের নিয়ে আসার জন্য তাদেরকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে তারা। তারা শ্রেণি সংগ্রামের কাঠামোয় হেফাজতের কর্মী বা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ‘বঞ্চিত’ বা প্রলেতারিয়েত হিসেবে ভাবেন। বিপরীতক্রমে মূল ধারার উৎপাদনমুখী শহুরে মধ্যবিত্তরা তাদের দৃষ্টিতে বুর্জোয়া শ্রেণি।

মজার ব্যাপার হলো মাদ্রাসায় পড়ুয়া, এতিম-মিসকিন বলে মনে করা হলেও, হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি কিন্তু বলে তার ঠিক উল্টোটা। আলোচিত হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বক্তৃতাগুলো শুনলে যে কারও মনে হবে যে, তারা এদেশের বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রক। এবং তারা এদেশের অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি। তাছাড়া ওয়াজ মাহফিলগুলোতে এসব আলেমের অংশগ্রহণের মহরত কিংবা সম্মানির হার শুনলেও বোঝা যায় যে, তারা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করেন। এমনকি ধর্মপ্রচারের যে বিরাট অর্থনীতি এদেশে আছে, যা সাধারণ মানুষের দান-খয়রাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার আকার-আকৃতিও অর্থনীতিবিদদের জন্য ভাবনার খোরাক। 

হেফাজতে ইসলামের শক্তির উৎস আসলে একটি সামাজিক এবং অন্যটি রাজনৈতিক। প্রথমত, জনগণের মাঝে এই শ্রেণির শক্তিশালী সাংস্কৃতিক এজেন্সি রয়েছে। মানুষের জন্ম, বিয়ে, মৃত্যুসহ সব ক্ষেত্রে যেসব আবশ্যক ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা রয়েছে, সেগুলোর মূল বিধায়ক হিসেবে এই শ্রেণিকে একক নিয়ন্ত্রণ দেয় মানুষ। এক্ষেত্রে অন্য কারও অংশগ্রহণ এ সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। মসজিদে মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন পদে যারা রয়েছেন তারা প্রায় সবাই হেফাজতের ১৩ দফার সমর্থক ও প্রচারক। ধর্মীয় নেতৃত্বের একক নিয়ন্ত্রণের কারণে মানুষ এদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, অনুসরণ না করলেও অন্তত বিরোধিতা করতে সাহস পায় না। 

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোও জনতুষ্টিবাদী অবস্থান নেওয়ার কারণে এই শ্রেণির সঙ্গে সখ্য রক্ষা করে চলে বা চলতে চায়। এই আলেম শ্রেণির সামাজিক অবস্থানকে রাজনীতিকরা মনে করে জনগণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম। এই রাজনৈতিক স্বার্থেই রাজনীতিক নেতারা বিভিন্ন স্থানে হেফাজত নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন। নেতাদের সহযোগিতায় মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা চলে। কাজেই পুরো ব্যাপারটা বহুকাল ধরেই একটা ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার বিন্যাস হিসেবে চলে আসছে, যেখানে নেতারা রাজনীতিক ক্ষমতায় থাকার জন্য মৌলবীদের সামাজিক ও ধর্মীয় বৈধতাকে কাজে লাগান, আবার উল্টো দিকে মৌলভিরা ধর্মীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে নেতাদের সহায়তা-পৃষ্ঠাপোষকতা নেন। 

ক্ষমতায় এই ভারসাম্য থেকে দেখলেই বোঝা যায়, হেফাজত নেতারা, সরকারকে ‘আজীবন’ ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি দেয়। তারা ইসলামী এজেন্সিটাই নির্বিবাদ ও নিরাপদ রাখতে চায় তাদের জন্য। ইসলামের রক্ষার দাবিতে তাদের নানা দাবি ও চাপ প্রয়োগের মূল কারণও হলো এই ধর্মীয় প্রতিনিধিত্ব নিরাপদ রাখা। অন্য দিকে, ২০১৩ সালের ৫ মে’র শাপলা চত্তরের সমাবেশের পরেই হেফাজতে ইসলাম সরকারের নৈকট্যে আসার সুযোগ পায়। তৎকালীন প্রধান নেতা আহমদ শফীকে সরকার বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে এ সংগঠনটিকে নিজের পকেটে রাখতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা কওমী মাদ্রাসার সদনকে সাধারণ শিক্ষার সমমানের স্বীকৃতি দেন। এর ফলশ্রুতিতে সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমী জননী’ খেতাবও প্রদান করে। কিন্তু আহমদ শফীর মৃত্যুর পর থেকে সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরকে কেন্দ্র হেফাজত হঠাৎ করে সরকারের বিপরীতে চলে যায়।

সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক কর্মসূচি মনে হলেও বাস্তবে হেফাজতের চরিত্রের মধ্যে রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার কোনো বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান নয়। তবুও কেউ কেউ হেফাজতকে রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখতে চান। 

তাছাড়া অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, কওমি ঘরানার আলেমদের নানা সময়ে রাজপথ উত্তপ্ত করলেও গত কয়েক বছরে এই শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। এছাড়া হেফাজতের মধ্যেই খেলাফত মজলিশসহ একাধিক দল রয়েছে, যারা সরাসরি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং ওই সব দলের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ রয়েছে। এই প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে হলে প্রথমত, স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন হেফাজতের এই রাজনৈতিকায়নের সুযোগটি কীভাবে শুরু হলো। স্পষ্টতই, গেল ১০ বছরে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে কোনো রাজনীতি চলছে না। জনগণের কাছে সরকারি দলের কোনো গণতান্ত্রিক বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। একইভাবে আস্থা রাখার মতো কোনো বিরোধীদলীয় রাজনীতিও বহুদিন ধরে অনুপস্থিত। এই শূন্যস্থানের সুযোগটিই হেফাজতে ইসলামের কিছু কিছু নেতা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। 

সেই সঙ্গে তারা ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বের যে সামাজিক স্বীকৃতি তাদের রয়েছে, সেটিকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। হেফাজতের রাজনীতিকায়নের পেছনে আরেক দিকে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকেও বড় অংশে দায়ী করার সুযোগ রয়েছে। কেননা, সরকারের বিরোধিতায় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। 

পাশাপাশি তারাই সরকারের বিরুদ্ধে হেফাজতকে প্রক্সি বা ছায়া শক্তি হিসেবে সহযোগিতা করতে চেয়েছে। এ প্রবণতা ২০১৩ সালের ৫ মের আগের দিন বিএনপির কর্মসূচি থেকেই স্পষ্ট হয়েছিল।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫