রেজা-নুরের নতুন দল
রাজনীতিতে তারুণ্যের প্রতিশ্রুতি

জাকারিয়া পলাশ
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২১, ১১:৩৭

ছবি: সংগৃহীত
আশাজাগানিয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ। ২৬ অক্টোবর রাজধানীর পল্টনে এক ঘরোয়া সমাবেশে এ দলের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরকে সামনে নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে চলছিল নতুন দল গঠনের কার্যক্রম। অবশেষে এ দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া। ড. রেজা কিবরিয়াকে আহ্বায়ক ও নুরুল হক নুরকে সদস্য সচিব করে প্রায় একশ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিও গঠিত হয়েছে দলটির।
আত্মপ্রকাশের সময় দলটি গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থকে তাদের রাজনীতির মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে তুলে ধরে দলটির ২১ দফা কর্মসূচি। ঘোষিত কর্মসূচিতে তুলে ধরা হয়েছে গণমুখী রাজনীতির প্রতিশ্রুতি আর রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্রের ব্যবস্থা থেকে বের করে সার্বজনীন করার প্রত্যয়।
আরও পড়ুন: সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণমানুষের সরকার প্রতিষ্ঠায় আমরা কাজ করব: ড. রেজা কিবরিয়া
গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার ও সুশাসন, নারীদের অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি, সকল জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বীর জন্য ভীতিহীন পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপনের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে দলের কর্মসূচিতে। একই ব্যক্তিকে একইসঙ্গে দলীয় প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান না করা এবং ১০ বছরের অধিক সময় কোনো ব্যক্তি দলের প্রধান বা সরকারপ্রধান না করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন, মুক্তগণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। স্বদেশপন্থী দৃঢ় প্রতিরক্ষানীতির কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে দলের কর্মসূচিতে।
এরই মধ্যে নানা কারণে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে এ দলের আবির্ভাব। অনেকেই মনে করছেন রাজনীতির মাঠে বিকল্প বিরোধী শক্তি হিসেবে তাদের গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে কোনো মহল থেকে। কারও কারও সন্দেহ ও অনুমান হচ্ছে, ভঙ্গুর ও অস্থির অবস্থার কারণে বিএনপি যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে, তারই সুযোগ নিয়ে বিএনপির ভোট ব্যাংককে বিভক্ত করে এই দল মূলত ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা করবে; কিন্তু দল ঘোষণার সময় আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার কথায় যে প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে তা বিপুল মানুষের মনে নতুন স্বপ্ন জাগিয়েছে। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে আমরা তৃতীয় রাজনৈতিক দল হতে আসিনি। আমরা ৪ শতাংশ জনসমর্থনের বিশেষ একটি দলের মতো, কিংবা ১২ শতাংশ জনসমর্থন থাকা ক্ষমতাসীন দল হতেও আসিনি। ইনশাআল্লাহ, ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’ এদেশে এক নাম্বার রাজনৈতিক দল হবে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ আসলে কী করতে পারবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে দেশের চরম কর্তৃত্ববাদী রিজিমের মধ্যেও যে তরুণরা গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার আর জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কথা বলছেন, তাদের শুধুই অনুমানের ভিত্তিতে সন্দেহ করা উচিত হবে না। ভিপি নুর ও তার সঙ্গীরা হঠাৎ করেই দল গঠন করেনি। বারবার আঘাত-হামলা আর স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই তরুণরা। হার না মেনে অদম্য এক সংশপ্তক হিসেবে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভিপি নুর। কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এই দীর্ঘ সংগ্রাম মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ ছিল না, সেখানে এই চেষ্টাটি যারা করেছেন তাদের ইতিবাচকভাবে দেখার পক্ষেই মত দিচ্ছেন অনেক বিশ্লেষক।
বিশ্লেষক ও সমালোচকরা আরও বলছেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভীষণ জনপ্রত্যাশার চাপ নিয়ে যে দল গড়ে ওঠে, তারা চাইলেই বিচ্যুত হতে পারে না। তারা কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে জনগণকে বোকা বানাতে পারবে না। এ জন্য জনগণের প্রত্যাশার চাপ ও সম্পৃক্ততা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান দল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা কোনো গোলটেবিল বৈঠক থেকে উঠে আসা দল নই, রাজপথে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের জন্ম। কোনো তৃতীয় শক্তি হওয়ার জন্য নয়, আমাদের লড়াই জনগণের মুক্তির জন্য।’
অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদপত্র দৈনিক শেয়ার বিজের সম্পাদক মীর মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নুরুল হক নুর মাটির সঙ্গে সংযুক্ত, দক্ষ এবং স্মার্ট। সে এরই মধ্যে দেশপ্রেমিক এবং অনেক দক্ষতায় পূর্ণ ড. রেজা কিবরিয়াকে সম্পৃক্ত করেছেন। তার এ দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে।’ এ দল সম্পর্কে নাগরিক পরিষদ নামের একটি সংগঠনের আহ্বায়ক শামসুদ্দীন আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সুশাসনের অঙ্গীকারে দুর্বৃত্তায়িত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের যে বলিষ্ঠ ঘোষণা তা সকলকে উজ্জীবিত করেছে। তারা জয়ী হলে বাংলাদেশ জিতে যাবে। তাদের অঙ্গীকার মানুষের মধ্যে সীমাহীন ও আকাশচুম্বী প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে।’
সব মতামতের সমন্বয় করে নতুন এ রাজনৈতিক দলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন-
এক. দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এ দল একটি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার ফল। এদের মধ্যে হঠাৎ ইউটার্নের চেয়ে লক্ষ অর্জনে স্থির ও অটুট থাকার মানসিকতাই আশা করা যায়।
দুই. এ দল তার উত্থানের শুরু থেকেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবার অধিকারের জন্য কথা বলেছে। একটি সফল সামাজিক আন্দোলন থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে ধাবিত হয়েছে। ফলে এরা জনপ্রত্যাশার মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে। দলের নতুন কর্মসূচিতেও অধিকার ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তারা জনপ্রত্যাশার সমন্বয় করেছে। নারীদের সম্পৃক্ত করা নিয়ে দলের আহ্বায়কের বক্তব্যটি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই নারীরা সত্যিই রাজনীতিতে অবদান রাখুক। নারীরা যেন দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত বোধ করে আমরা দলে সে পরিবেশ নিশ্চিত করব।’
তিন. দলটি রাজনীতিকে অভিজাত শ্রেণির বেড়াজাল থেকে বের করে, সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এ দলের অধিকাংশ নেতাই গ্রামীণ মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা বরাবরই জাতীয় রাজনীতিতে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। ফলে তারা এলিট শ্রেণির অতিথি কক্ষ থেকে রাজনীতি চর্চাকে গণমানুষের ঘর-গৃহস্থালীতে নিয়ে যেতে সক্ষম।
চার. এ দলটি গতানুগতিক কোনো মহান ব্যক্তির চমকের ওপর গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তিপূজা বা পরিবারতন্ত্রের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপনের কথা ঘোষণা করেছে। বৈষম্যের শিকার হওয়া শিক্ষিত তরুণদের সমন্বিত উদ্যোগই এ দলের মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। পরে সে সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য থেকে সাহস ও অদম্য মানসিকতার বলে বিকশিত হয়েছিল নুরুল হক নুরের মতো নেতা।
পাঁচ. গণঅধিকার পরিষদের দল গঠনের প্রক্রিয়া চলাকালে নানা সংশয় ছিল এ দলের অবস্থান নিয়ে। অনেকেই বলছিলেন, বামপন্থীদের সঙ্গে মিশে ভিপি নুরেরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। আবার বিপরীত দিকের অভিযোগ ছিল, ভিপি নুর সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ডানপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সবশেষে রাজনৈতিক দল ও কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, গণঅধিকার পরিষদ ডান-বামের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার আর জাতীয় স্বার্থকে মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জনগণ আজ নুরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিভক্ত জাতিকে নুরুল হক নুর ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন। বাম-ডান সব সংগঠন নুরের প্রশ্নে একমত। এই অবস্থায় শান্তিপ্রিয় জনগণ ও নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আগামীতে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠন করতে হবে।’ তিনি নতুন দলে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক করে বলেন, ‘গণঅধিকার পরিষদে কর্মীর অভাব হবে না। তবুও কর্মী বাছাইয়ে সদস্যের দেশপ্রেম, ত্যাগ, মনুষ্যত্ব, নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক জ্ঞানকে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তার অসৎ কর্মীদের কারণেই জনবিচ্ছিন্ন হয়।’
ছয়. অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, এ দলে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস আর উদ্যোম আছে; কিন্তু তার সঙ্গে মেধা ও দক্ষতার সমন্বয় কম। ড. রেজা কিবরিয়ার মতো মেধাবী ও আন্তর্জাতিক মানের ব্যক্তি দলের প্রধান হওয়ায় সে সংশয়ের অবসান হয়েছে। তাছাড়া অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, সদ্য ছাত্রত্ব শেষ করা বেকার মধ্যবিত্তের নানা পিছুটান রয়েছে। তারা রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যেভাবে লেগে থাকার প্রয়োজন, হয়তো তা করতে পারবেন না; কিন্তু দলের কমিটিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উঠে আসা তরুণ নেতার সঙ্গে মাঝবয়সী নানা পেশাজীবীর সমন্বয়ও ঘটেছে। এটাও নির্দেশ করে এ দল অগ্রসর হচ্ছে পরিপক্বতার দিকে।