-6207326dec8ea.jpg)
বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ দলের সদস্য সচিব নুরুল হক নূর ও আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া
তিন মাস হলো রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ। এরই মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এ দলটি। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার পাচ্ছে এর কর্মসূচি। আবার রাজনীতি, নির্বাচন এবং দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে শক্তিশালী অভিমত প্রকাশ করছেন এ দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব নুরুল হক নূর। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহলও নানা দিক থেকে পর্যালোচনা করছেন দলটির গতিপ্রকৃতি নিয়ে।
শুরুতেই বলা ভালো, আত্মপ্রকাশের আগেই ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর সামাজিক মাধ্যম ও তরুণ সমাজের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ‘রাজনৈতিক সেলিব্রিটি’ হিসেবে একটা ইমেজ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। নুরুল হক নূরের পাশাপাশি ২০১৮ সালের আলোচিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা আরও এক ঝাঁক তরুণ জাতীয় ও রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে বেশ সরব ছিল। তবে সেটা অনেকটাই জাতীয় প্রেসক্লাব ও শহীদ মিনারের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আর ফেসবুক বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরই দলটির বেশ কিছু কর্মসূচি বুদ্ধিজীবী ও পর্যবেক্ষক মহলের কাছে সাড়া ফেলেছে।
দলের আত্মপ্রকাশের পরই ডিসেম্বর মাসে দলের আহ্বায়ক ও অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া এক ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ঠিক সে সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পুলিশি সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাবে) ও এর সংশ্লিষ্ট কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর অবরোধের নির্দেশনা আসে। পরবর্তীকালে একাধিক আলোচনায় ড. রেজা কিবরিয়াকে গণমাধ্যম কর্মী ও জনপ্রিয় উপস্থাপকরা এ প্রশ্ন করেছেন যে, অবরোধের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে কি-না?
অবশ্য শুরু থেকেই ড. রেজা কিবরিয়া বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন, এটা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লবিং বা তদবিরের ফলাফল নয়। এটা মানবাধিকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ- যা ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্ট নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ১০ জন সদস্য সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর কোনো দেশ, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবরোধের প্রস্তাব করলেই তা বাস্তবায়ন করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সংশ্লিষ্ট স্থানের মানবাধিকারের পক্ষে ভূমিকা নেওয়ার জন্যই এটা করা হয়, এটা কোনো কূটনৈতিক অস্ত্র নয়।
পরে ২১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে গণঅধিকার পরিষদ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আমাদের কারণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ওই আলোচনা সভায় ড. রেজা কিবরিয়া তাঁর বাংলা বক্তব্যের পাশাপাশি বিদেশি গণমাধ্যম ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে বক্তব্য দিয়েছেন। সে বক্তব্যেও তিনি তুলে ধরেন যে, র্যাবের মতো সংস্থার কারণে গুম হয়ে যাওয়া ভুক্তভোগী লোকদের স্বজনরা তাদের প্রতিবাদটুকুও করতে পারেনি। তাদের মধ্যে এই অবরোধের কারণে নতুন আশাবাদের সঞ্চার করেছে যে, তারা সুবিচার পাবেন।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ইকোনোমিস্ট ২৯ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ড. রেজা কিবরিয়ার বরাত দিয়ে এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে এ অর্থনীতিবিদকে পরিচয় করানো হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কর্মকর্তা, যিনি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে রাজনৈতিকবিরোধী শক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন।
ইংরেজিতে দেওয়া ড. রেজা কিবরিয়া এ বক্তব্যকে নানা দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক মাশফিক ওয়াদুদ তার ফেসবুক পেজ-এ লিখেছেন, ‘ড. রেজা কিবরিয়ার ফেসবুক পেজে দেওয়া বক্তব্যটির প্রায় দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) দর্শক দেখেছেন। যে কোনো রাজনীতিবীদের জন্য এটি বড় একটি বিষয়। ফেসবুক সেলিব্রিটিদের ভিডিওর এমন দর্শক হয়তো নেই। একটি সমাবেশের বক্তব্যের মাত্র ১৬ দিনে দুই মিলিয়ন ভিউ হওয়া বলে দেয় ড. কিবরিয়া বাংলাদেশের স্যোশাল মিডিয়ায় বেশ ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সেটা খুব অল্প কিছু দিনে। তার দলের আরেকজন নেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর ও বেশ জনপ্রিয় তরুণ সমাজের কাছে। প্রশ্ন হলো ড. কিবরিয়া এবং নূরের এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তাদের দল দেশের রাজনীতিতে শক্ত ভিত্তি করতে পারবেন কি-না?’
ড. রেজার বক্তব্যকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। এ প্রসঙ্গে মাশফিক ওয়াদুদ বলেছেন, ‘বক্তব্যগুলো গুছিয়ে লেখা। কনটেন্ট ভালো এবং তার ভালো একটি ব্যক্তিত্ব আছে। তবে তার মধ্যে এক ধরনের আভিজাত্য (এলিটিজম) আছে অথবা দেশের মানুষ তাকে এলিট ভাবেন। এটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এলিটিজম যাদের মধ্যে আছে, তাঁরা আসলে গণমানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেননি।’
ড. কিবরিয়ার ইংরেজি বক্তব্য নিয়ে কবি ও তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহারও এক বিরাট মন্তব্য লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রেজা কিবরিয়া পরাশক্তির প্রতি উদ্দেশ্য করেই ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করলে ভালো দেখাতো। অধিকার পরিষদের ভাবমূর্তি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি চিন্তাচেতনায় একজন সেক্যুলার আওয়ামী লীগার, অধিকার পরিষদের আন্দোলনের বাইরে থেকে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তি। তিনি কামাল হোসেনের গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অতএব, রেজা কিবরিয়া অধিকার পরিষদের এত দিনের রাজনীতি ও গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মর্ম অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমি মনে করি না।’
ফরহাদ মজহারের এ বক্তব্যের পাল্টা বিশ্লেষণও করেছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক খোমেনী ইহসান লিখেছেন, ‘ফরহাদ মজহার অধিকার পরিষদের আহ্বায়ককে বহিরাগত বলার মতো কুৎসিত রাজনীতি করে অন্য তরুণ নেতাদের বিভ্রান্ত করছেন এবং তাদের বড় হওয়ার পথটাকে শুরুতেই জটিল করতে চেষ্টা করছেন। গণঅধিকার পরিষদে ইংরেজি বলা ড. রেজা কিবরিয়ার পাশাপাশি আরবি উর্দু হিন্দি বলা লোক আছে। খোদ নুরুল হক নূর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তারা এমন সময়ে রাজনীতি করতে এসেছেন, যখন প্রয়োজনে সব ভাষা ও মিডিয়া ব্যবহার করতে পারতে হবে। অন্যথায় দেশের সব ধরনের লোকের কাছে তাদের কথা পৌঁছাবে না। রেজা কিবরিয়া বড় লোকের ছেলে বলে নয়, নূরের অনেক সহপাঠীর জন্যও ইংরেজিতে কথা বলাটা জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশে যারা অরাজনৈতিক জায়গা থেকে পলিসি ও স্ট্র্যাটেজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, তাদের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিতে হলেও ইংরেজি বলা দরকার। আর রাজনীতির লোকেরা যখন ইংরেজি বলে তখন ক্ষমতাবলয়টা উল্টে-পাল্টে যায়।’
ফরহাদ মজহারের পাল্টা সমালোচনা করে অধিপত্যবাদ বিরোধী সংগঠন নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন বলেছেন, ‘দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় সচেষ্ট হবেন ভাল; কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়িত অবস্থার অবসানে রেজা কিবরিয়ার হাতকে শক্তিশালী না করে বিতর্কিত করতে চাচ্ছেন কেন? গণ অধিকার পরিষদের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করতে দ্বিধা, শঙ্কা আর সংশয় ঢুকিয়ে দিয়ে কার পক্ষ নিচ্ছেন? স্পষ্ট করুন ফরহাদ মাজহার সাহেব।’ দল হিসেবে গণঅধিকার পরিষদের বয়স ও পরিসীমা এখনো তেমন বিস্তৃত হয়নি; কিন্তু এ দলের আহ্বায়কের একটি বক্তব্যই দলের বাইরে বিশ্লেষকদের মধ্যে এমন নানা বিশ্লেষণের জন্ম দিতে পেরেছে।
র্যাব ও এর সংশ্লিষ্টদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের এ সক্রিয় তৎপরতার বিশ্লেষণ করে সদ্য গঠিত এ দলটির বিদেশীনীতি নিয়েও বিশ্লেষণ হচ্ছে। অনেকেই এর মধ্যে ‘বিদেশ নির্ভরতার’ ইঙ্গিত খুঁজছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সাংবাদিক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, ‘আমাদের রাজনীতির মূলনীতি হচ্ছে- গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয়স্বার্থ। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও এর বাইরে নয়। আমরা বরাবরই এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে আসছি। যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ না দিলেও আমরা গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলতাম। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে আমরা এতদিন যা বলছিলাম তা আরেকবার শক্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলা নিঃসন্দেহে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী নয়।’