মৃতপ্রায় জাসদের নিজস্ব রাজনীতি

সমাজ বদলের অঙ্গীকার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তবে সমাজ এখনো বদলে দিতে পারেনি। বরং ৪৮ বছরে ভাঙা-গড়ার খেলায় নানা রূপে হাজির হয়েছে দলটি। তিন টুকরো হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিত্র হয়ে টিকে থাকলেও জাসদের নিজস্ব রাজনীতি এখন মৃতপ্রায়।

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধে ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর (অব.) এম এ জলিল এবং ছাত্রলীগের এককালীন সাধারণ সম্পাদক, ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আব্দুর রবকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির যাত্রা শুরু হয়।

একই বছরে ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অতিরিক্ত কাউন্সিলে ১০৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে জাসদ তার ঘোষণাপত্রও অনুমোদন করে। সেই ঘোষণাপত্রে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা শ্রেণিহীন শোষণহীন কৃষক শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়া হয়।

৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, শতকরা ৭ ভাগ (১,২২৯,১১০) ভোট পেয়ে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়।

১৯৮০ সালে বিভিন্ন বিতর্ককে কেন্দ্র করে প্রথম জাসদ ভাঙনের কবলে পড়ে এবং জাসদ থেকে বেরিয়ে একদল নেতা বাসদ গড়ে তোলে। ১৯৮৪ সালে আরেক দফা ভাঙন হয়। ১৯৮৬ সালে কাজী আরেফ আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ জাসদ (ইনু) হিসেবে পরিচিতি পায়।

১৯৯৭ সালে জাসদ (রব), জাসদ (ইনু) এবং বাসদ (মাহাবুব) এর একাংশ মঈন উদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়, আ স ম রব সভাপতি এবং হাসানুল হক ইনু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে আ স ম রবের নেতৃত্বে কতিপয় নেতা জেএসডি নামে জাসদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

২০০৪ সালে থেকে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ ১৪ দল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে মহাজোট গঠিত হলে জাসদ (ইনু) মহাজোটের শরিক হয়। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মার্চ জাসদের জাতীয় সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। ১২ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সেশন শেষে নির্বাচনী অধিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নেতা নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন (এ সময় মূলত দলীয় সাংগঠনিক পদ বিলুপ্ত হয়)।

হাসানুল হক ইনু সর্বসম্মতভাবে একক প্রার্থী হিসেবে কণ্ঠ ভোটে সভাপতি পুনঃনির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক পদে শিরীন আখতার ও নাজমুল হক প্রধানের নাম প্রস্তাব আসে। এ সময় শ্লোগান দেয়াকে কেন্দ্র করে উভয় প্রার্থীর পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নেতৃত্বে কিছু কাউন্সিলর কাউন্সিল অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত হলে কাউন্সিলররা কাজী বশির মিলানায়াতনে (মহানগর নাট্যমঞ্চ) সাংগঠনিক নিয়মে সরাসরি সাধারণ সম্পাদক পদে গোপন ব্যালটে ভোট প্রদান করেন। শিরীন আখতার পান ৬০৩ ভোট এবং নাজমুল হক প্রধান পান ১২৩ ভোট পান। প্রাপ্ত ভোটে শিরীন আখতার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

অন্যদিকে কাজী বশির মিলনায়াতন (মহানগর নাট্যমঞ্চ) ত্যাগকারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে সমাবেশ করে, শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি, নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক এবং নিজেকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা করেন মঈন উদ্দিন খান বাদল। এর মাধ্যমে কার্যত জাসদের আরেক দফা বিভক্তি চূড়ান্ত হয়।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আত্মপ্রকাশ করা দলটি আদর্শিক কারণে ভেঙে গেছে। তবে এখনো উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখে জাসদের তিন অংশই।

জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে জনগণের মুক্তির লড়াইকে প্রাধান্য দিয়ে ঐক্যকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি এটাই সত্যি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই রাজনীতি লালন করবো ও ধারণ করবো। রাজনৈতিক দীর্ঘ পরিক্রমায় কৌশলগত প্রশ্নে ভুল বা ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নাই। এটা হতেই পারে।

তিনি জানান, শ্রম কর্ম, পেশার প্রতিনিধিত্বের রাজনীতিতে এক নতুন শক্তির উন্মেষ ঘটবে, বাঙালী জাতীয়তাকে উচ্চতর ধাপে উন্নত করবে। সর্বোপরি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের কর্মসূচীর কোন বিকল্প নাই।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, মূল জাসদ চলছে, আর যারা পা পিছলে চলে গেছে তারা কিন্তু ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই চলে গেছে। আম্বিয়া সাহেবসহ যারা দলটা ছেড়ে চলে গেছেন তাদের ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশ হয়তো মিলাতে পারেন নি। দেশের হিসেব ও জনগণের হিসেব মিলাতে গেলে আমাকে শেখ হাসিনার সঙ্গে ও আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ঐক্য গড়তে হবে। খালেদা জিয়া, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদের সঙ্গে নয়। আমার মনে আমাদের সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা নিয়ে এ ঐক্যের মধ্যে আমরা লাভবান হয়েছি।

তিনি জানান, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে আমরা একচুল কাউকে ছাড় দেইনি। সুতরাং জাসদ কিন্তু সেই অর্থে ব্যর্থ হয়নি। ব্যর্থতা যদি বলেন, আমি সমাজতান্ত্রিক সমাজে নির্মাণে সফল হইনি।

বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ইনু নিজের ইচ্ছেমত দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো। এবং সেই থেকে দলের ভিতর বিদ্রোহ হয়ে গেছে। এই সরকারের পেছনে থেকে সামনে অগ্রসর হওয়ার আমি কোন জায়গা দেখিনা। আওয়ামী লীগের বর্তমান যে অবস্থায় সেখানে ১৪ দল ফাংশন করার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। তার শরিকদেরও সে নিঃশেষ করে দিবে, আর দুর্বল অ্যান্টি লিবারেলকে রেখে সে রাজত্ব করবে।

তিনি জানান, দলের যে রাজনৈতিক সংস্কার সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটা টেকসই গণতন্ত্র যেন আমরা করতে পারি সেজন্য আমরা কাজ করবো।

হাসানুল হক ইনুর অংশ আওয়ামী লীগের মিত্র, আসম আব্দুর রবের অংশ বিএনপির নির্বাচনি জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক আর শরীফ নুরুল আম্বিয়ার অংশ চৌদ্দ দলে আর থাকতে আগ্রহী নয়। বড় দলের ছায়াতলে থেকে জাসদের রাজনীতির অস্তিত্ব কোথায় এমন প্রশ্ন উঠে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //