আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি যেখানে ভোগবাদ প্রতিনিয়ত প্রবল হয়ে উঠছে। কর্পোরেট পুঁজি ও সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমাগত আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে চারপাশের বিলাসিতা এবং সাফল্যের বিমূর্ত ছবি। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের রঙিন ফাঁদে আটকে পড়তে পারেন সহজেই। যেখানে আপনার আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যয় বৃদ্ধি সূক্ষ্মভাবে আপনার দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক লক্ষ্য এবং স্বপ্নগুলিকে লাইনচ্যুত করতে পারে। একটি সুস্থ আর্থিক জীবন বজায় রাখার জন্য জীবনযাপন কেমন হওয়া উচিত তা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চলুন দেখে নেওয়া যাক বিলাসী জীবনযাপনের রঙিন ফাঁদে পড়লে কিভাবে নষ্ট হতে পারে আপনার সুন্দর সুস্থ স্বপ্নগুলো।

১. বিলম্বিত আর্থিক লক্ষ্য
প্রতিনিয়িত বিলাসী রঙিন জীবনযাপন করতে চাওয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাবগুলির মধ্যে একটি হল আপনার আর্থিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেরি হওয়া। একটি বাড়ির জন্য সঞ্চয় করা হোক না কেন, স্টকে বিনিয়োগ করা হোক বা অবসরের তহবিল তৈরি করা হোক না কেন, এই উদ্দেশ্যগুলির জন্য আপনি যে অর্থ বরাদ্দ করতে পারতেন তা বিলাসী জীবনযাপনের বর্ধিত ব্যয় নষ্ট করে ফেলে। আপনি অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলিতে যত বেশি ব্যয় করেন, আপনার স্বপ্নগুলি অর্জন করতে তত বেশি সময় লাগে।

২. বর্ধিত ঋণ
আপনার জীবনধারা আয়ের চেয়েও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠলে, আপনি এটি বজায় রাখতে ক্রেডিট কার্ড বা ঋণের উপর বেশি নির্ভর হতে শুরু করেন। উচ্চ সুদের হার এবং সঞ্চিত ঋণ এমন একটি দুষ্ট চক্র যাতে কেবল আপনার আর্থিক বোঝা বাড়বে। এ ধরনের উচ্চাভিলাষ আপনার ড্রিমপ্রজেক্টে বিনিয়োগ করা কঠিন করে তোলে; হোক না সে নতুন কোনো উদ্যোগ, শিক্ষা, ভ্রমণ বা অন্য কিছু। 

৩. কম সঞ্চয়
বিলাসী জীবনধারার অর্থই হচ্ছে সঞ্চয় কমে যাওয়া। কারণ, আপনি জরুরী প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চিত রাখতে পারতেন; আপনার উচ্চাভিলাসী জীবনযাপন তাতে বাঁধ সাধে। সঞ্চয়ের এই হ্রাস আপনার জীবনের অপ্রত্যাশিত সময়গুলোতে (জরুরী মেডিকেল অবস্থা বা চাকরি হারানো) আর্থিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে, আপনার দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। 

৪. বিনিয়োগের সুযোগ হারানো
ব্যয়বহুল জীবনযাপন করলে সঞ্চয়ের মতো ভবিষ্যত বিনিয়োগের সুযোগ কমতে থাকে। রিয়েল এস্টেট, স্টক বা একটি স্টার্ট-আপ ব্যবসাই হোক না কেন, জীবনে কেবল বর্তমানের ভোগবিলাসিতা টিকিয়ে রাখতে চাইলে এসব সুযোগগুলি হারাতে হতে পারে। সকলের এটা মনে রাখা উচিত- বিনিয়োগই মানুষকে ধনী করে তোলে, চাকরি না। আর তাই বর্তমানে বেশি অর্থ ব্যয় করার জন্য বিনিয়োগ করতে কখনই অবহেলা করা উচিত না।

৫. অবসর পরিকল্পনার সাথে আপস করা
বর্তমানের উচ্চাভিলাসী জীবনযাপন আপনার অবসর পরিকল্পনার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। আপনি এখন যত বেশি ব্যয় করবেন, অবসর গ্রহণের জন্য আপনার সঞ্চয় করার সম্ভাবনা তত কম। এর অর্থ হতে পারে প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় কাজ করা, আপনার সোনালী বছরগুলিতে আপনার জীবনের গুণমান হ্রাস করা, বা আপনার অবসরকালীন জীবনযাত্রার সাথে আপস করা।

৬. কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনে ভারসাম্যহীনতা
আপনি হয়তো বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারেন বা আরও বেশি সৌখিন জীবনধারাকে সমর্থন করার জন্য অতিরিক্ত চাকরি নিতে পারেন। যাইহোক এটি কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনে ভারসাম্যহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এর ফলাফল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভাল হবে না। 

৭.  জীবন থেকে সুখ এবং পূর্ণতা হারিয়ে ফেলা
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিলাসী জীবনযাপনের ফলে আপনি হারিয়ে ফেরতে পারেন সুখ এবং পূর্ণতা। আপনি বস্তুগত সম্পদ এবং আরও বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পিছনে ছুটতে গিয়ে জীবনের সত্যিকারের অর্থ হয়তো হারিয়ে ফেলবেন। জ্ঞান, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক এবং আত্মিক উন্নয়ন প্রায়শই বস্তুগত পণ্যের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সন্তুষ্টি প্রদান করে- গবেষণায় এটা প্রমাণিত।

করণীয় কী: 
উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের সমস্যাগুলি এড়াতে, এই কৌশলগুলি অবলম্বন করা যেতে পারে। 

বাজেটিং: আপনার খরচের হিসাব রাখুন এবং একটি বাজেট সেট করুন যাতে সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের লক্ষ্য থাকে।

আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ: আপনার আর্থিক লক্ষ্যগুলি পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করুন এবং নিয়মিত সেগুলি পর্যালোচনা করুন।

মননশীল ব্যয়: প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রয়ের প্রশ্ন করুন এবং আপনার আর্থিক লক্ষ্যগুলির উপর এর প্রভাব বিবেচনা করুন।

জরুরি তহবিল: অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে ঋণ এড়াতে একটি জরুরি তহবিল তৈরি করুন এবং তা বজায় রাখুন।

বিনিয়োগ: যে কোনো আয় বৃদ্ধির একটি অংশ বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ করুন।

জীবন এবং কাজের ভারসাম্য বজায় রাখা: আপনার কাজের প্রতিশ্রুতি যেন আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে আচ্ছন্ন না করে তা নিশ্চিত করুন।

পূর্ণতা খোঁজা: জীবনের অ-বস্তুগত দিকগুলিতে মনোনিবেশ করুন যা সুখ এবং পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে।

মনে রাখবেন, উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের নেশা আপনার ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষা এবং স্বপ্নের অর্জনের জন্য একটি সূক্ষ্ম কিন্তু শক্তিশালী হুমকি। অতএব সুস্থ আর্থিক জীবন বজায় রাখতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। না হলে জীবনের শেষ পর্যায়ে হারাতে হতে পারে অনেক কিছুই।