Logo
×

Follow Us

সম্পর্ক

ব্রেক আপের পর

Icon

ইয়ারা যোহারীন

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২০, ১৩:০৫

ব্রেক আপের পর

সামাজিক অবক্ষয়ের এক রূপ ব্রেক আপ। সম্পর্ক থাকলে একদিন ব্রেক আপও হতে পারে। বিষয়টি অস্থায়ী কর্পোরেট জবের মতোই স্বাভাবিক এ সময়ে। আধুনিক অনেক ছেলে মেয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে বিষয়টি। আবার অনেকের জীবন হতাশার অন্ধকারে নেশা কিংবা বিষাদগ্রস্ততায় হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের মেধা মানবিকতা স্বাভাবিক জীবনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে একেকটি সম্পর্ক। 

সভ্যতা যতই যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে যাক না কেনো আবেগকে এখনো পেছনে ফেলতে পারেনি। সম্ভবত এখনো পর্যন্ত মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভালবাসা। মানুষ এখনো বিশ্বাস করে তারা যা কিছু ই করে না কেনো তার কারণ হিসেবে কাজ করে ভালোবাসা।

ধর্মীয়গ্রন্থে সকল প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি বলা হয়েছে। জোড়ার ভালোবাসা তথা প্রেমেরই প্রতিফলনস্বরূপ বংশবৃদ্ধি ও সভ্যতার টিকে থাকা। নারীপুরুষের এ বন্ধন অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রেম যেনো ঈশ্বরেরই আশীর্বাদ। যে কোনো সময়ে, যে কোনো বয়সে মানুষ প্রেমে পড়তে পারে। কোনো শর্ত আরোপ করে নয়; কেবল দুজন মানুষের একান্ত ভালো লাগা থেকে সম্পর্কের শুরু। 

পারস্পারিক শ্রদ্ধা, খেয়াল রাখা, বোঝাপড়া, সহমর্মিতায় বেড়ে উঠে এ সম্পর্ক। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না অনেক প্রেম। অনেক সময় বিয়ে হয়ে গেলেও কিছুদিন পর হয় ডিভোর্স। দিন দিন বাড়ছে ডিভোর্সের সংখ্যা। ডিভোর্স নিয়ে জরিপ হলেও অবিবাহিত প্রেমের ব্রেক আপের গড় করা বোধ করি সম্ভবপর নয়। কেননা ঘর ভাঙ্গা দেখা গেলেও মন ভাঙ্গা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না।

ব্রেক আপের কারণ
বিভিন্ন জনের জীবনে বিভিন্ন কারনে ব্রেক আপ হয়। তবে কমন কিছু কারণ যেনো মিলেই যায়। আমাদের বাবা-মায়েদের জেনারেশনের কমন ব্যাপার ছিলো ছেলে মেয়ে সমবয়সী কিংবা ছেলে এখনো চাকরি পায়নি। তাই মেয়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে সময়টা পালিয়ে বিয়ে করাও ছিলো ভীষণ জনপ্রিয়। আবার ত্রিভুজ প্রেম ও ত্যাগের কাহিনীও আছে বাস্তবে ঠিক সিনেমার মতো। 

আমাদের দাদার জেনারেশনে পারিবারিকভাবে বিয়েটা একটু বেশিই দেখা যেতো। তারা ভালোবাসলেও বাবা-মাকে জানানোর সাহস পেতেন না এবং এক সময় বিবাহের আগে প্রেম পাপ বলেই গণ্য হতো আমাদের এখানে। প্রেম ছিলো ভীষণ গোপনীয়। বাবাদের যুগের ল্যান্ডফো , চাইনিজ খাওয়া কালচার পেরিয়ে আমরা সব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করছি প্রেমের ক্ষেত্রে অভিসারের জন্য জায়গাও বেঁধে দেয়া আছে ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টে। 

এখন সম্পর্কে কেবল তৃতীয় ব্যাক্তি নয় ৫ম থেকে ১২তম ব্যক্তি এলেও সারপ্রাইজের কিছু নেই। একে অপরকে চরম অবিশ্বাস, আস্থার অভাব, বেটার অপশন খোঁজা- সবই ব্রেক আপের কারণ।

ব্রেক আপের পরিণতি
ব্রেক আপের পরিণতি নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই খুব খারাপ। তার মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় তো ঘটেই সেই সাথে  সামাজিকতা, মানবকিতা সবক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে। প্যানিক এ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোক, ইনসোমোনিয়াসহ নানা রকম মানসিক রোগের শিকার হতে পারে ভিকটিম। অনেকে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। একজনকে ভুলতে অন্য আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। আবার কেউ কেউ  পরবর্তীতে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। সঠিক মানুষ জীবনে এলেও ফিরিয়ে দেয়। বিয়ে ভীতির ভীতিও কাজ করে।

কেস স্টাডি ১
সানজিদ সিয়াম ৩৪ বছর বয়সী পাত্রী খুঁজছেন। অফিসের ইন্টার্ন করতে আসা ২৫ বছর বয়সী রয়া জাহানের সাথে গড়ে উঠে সখ্যতা। তারা প্রায়শই অফিসের পর বাইরে খেতে যেতেন। রয়া শুরুতে জানান তার ব্রেক আপ হয়েছে। একমাস পর সিয়াম তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে রয়া উত্তর দেন, ‘কি যে বলেন ভাইয়া আমি তো আপনাকে বড় ভাইয়ের চোখে দেখেছি এতোদিন আর আমার তো বিয়ে ঠিক আছে আমার কাজিনের সাথে কানাডাতে থাকে ও।”  খবরটা সারা অফিসে হট কেক হয়ে যায় সিয়াম বাধ্য হয়ে তার জব বদল করে। 

কেস স্টাডি ২
প্রেরণা চৌধুরী ২৮ বছর বয়সী তরুণী। ইংলিশ মিডিয়ামের মিস। ৪ বছর আগে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় বন্ধু ও প্রেমিকের মৃত্যুর পর সিদ্ধান্ত নেন একা থাকার। কোয়ারেন্টিনে হঠাৎ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে অজানা আবির হাসানের সাথে। দিন দিন মুগ্ধ হোন এবং এক সময় তার ভালো লাগার কথা ছেলেটিকে জানান। ছেলেটি স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার পক্ষে তার চেয়ে দুই বছরের বড় আপুকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। প্রেরণা পরে জানতে পারেন ছেলেটি তার এক ছাত্রীর মামা। বাজি ধরেছিলেন মিসকে প্রেমে পড়াবেন। প্রেরণা ভেঙ্গে পড়েন এবং স্মার্ট মেয়ের মতোই অনলাইনে কাউন্সিলিংয়ের সহায়তায় জীবনে পরিবর্তন আনেন আবার। তবে অবশ্যই তার জন্য পরবর্তীতে অন্য কাউকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন হবে। 

২টি কেস স্টাডি উদ্দেশ্যমূলক মানহানিকর। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কারো মন ও ক্যারিয়ার নিয়ে খেলা করার কোনো শাস্তি আইনে নেই। তবে এটি মানবচরিত্রের অমানবিক এক পশুবৃত্তির প্রকাশ। কেননা অন্যের ক্ষতি করাই থাকে উদ্দেশ্য। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট নৈতিকতা প্রসঙ্গে বলেন,“ মানুষকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।” কিন্তু ব্রেক আপের ক্ষেত্রে দেখা যায় একে অপরকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করার যেন তুমুল প্রতিযোগিতা। 

ব্রেক আপের পর করণীয় 
এখনো আপনার হাতে সময় আছে জীবনকে নতুন করে সাজাবার। সম্পর্কেও আগেও আপনার অস্তিত্ব ছিলো। বাবা-মা, পরিবার এখনো পাশে আছে ভালোবাসে সবাই কেবল একজন ছাড়া। তাই একজনের জন্য আপনার পৃথিবীকে থামিয়ে দিবেন না।ব্রেক আপের পর শান্ত থাকা খুব জরুরি। কিছুতেই নেশা করা যাবে না এবং হঠাৎ আবার নতুন সম্পর্কে জড়ানো যাবে না।

সম্প্রতি কবির সিং সিনেমায় আমরা হিংসাত্মক এবং আত্মঘাতী আচরণ দেখেছি যা কারো কাম্য নয়। যেহেতু আমাদের হিন্দি সিনেমা খুব প্রভাবিত করে সেহেতু সিনেমার উদাহরণে আসি। এক জনের ধোঁকা থেকে নিজে সিরিয়াল লাভার এবং ১০০ জনের জীবন নষ্টের চ্যালেন্জ না নিয়ে শান্ত থাকুন। একজন আপনাকে মানসিক আঘাত করেছে বলে তার ক্ষতি করা কিংবা অন্য ইনোসেন্ট ১০০ জনের জীবন নিয়ে খেলার মধ্যে কোনো বীরত্বই নেই বরং নৈতিকভাবে আপনি ঘৃণিত হবেন। 

আমরা ডিয়ার জিন্দেগিতে আলিয়া ভাট ৪ বার ব্রেক আপ এবং পারিবারিক অশান্তির পরও কাউন্সিলরের সহায়তায় নিজের কাজে ফিরে যেয়ে পুরস্কার পেতেও দেখেছি। এতেই প্রমাণিত- যে জীবন থেমে থাকার নয়। আপনি হয়তো ভালোবেসে ১০ বারই আঘাত পেয়েছেন সেক্ষেত্রে আপনাকে সবার আগে ভালোবাসতে হবে নিজেকে। নিজের কাজকে এবং প্রফেশনাল কাউন্সিলর ছাড়া ব্যক্তিগত বিষয় কারো সাথে শেয়ার না করাই ভালো। নিজের ভাল লাগার কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। শারীরিক সম্পর্ক হয়ে থাকলেও নিজেকে নিজে অসম্মান করবেন না। আপনি পরিস্থিতির শিকার। 

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত মুহূর্ত ফাঁস হবার পরও ক্যারিয়ারের ভালো অবস্থানে আছেন তিনি। পাছে লোকে কিছু বলে লোকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। তাই সবই সম্ভব, সাহস রাখুন। প্রতিশোধ প্রবণ হবেন না, জাজ আপনি নন। প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান, ক্ষমা প্রার্থনা করুন। দ্রুত মানসিক শান্তি লাভ করুন। লেট ইট গো বলে রেগুলার মেডিটেশন, ডায়েট শরীরচর্চসহ কাজে পূর্ণ ব্যস্ত থাকুন। অন্যের জন্য কিছু করুন। পরিবার বন্ধুদেও সাথে আড্ডা দিন, বই পড়ুন, বেড়াতে যান। শিশুদের সাথে সময় কাটান। নিজের মনের বাচ্চাটাকে বাচ্চাপনা করতে দিন।

ব্যাক আপ প্ল্যান ফর ব্রেক আপ
যদিও ব্যাক আপ প্ল্যান করে কেউই প্রেমে পড়ে না। তবে যেহেতু সময়টা একটু অন্যরকম তাই কষ্ট পেতে না চাইলে একটু ট্রিকি হতে হবে। প্রেমের সম্পর্কে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিবেন না। এতে যদি র্পাটনার হাত ছাড়াও হয়ে যায় তাহলেও না। বোঝার চেষ্টা করুন তার কোন উদ্দেশ্য আছে কি না। পারলে একসাথে ভ্রমন করুন, সময় নিন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে শারীরিক সম্পর্ক নয়। না বলতে শিখুন। প্রেম বিয়ে মানে এই নয় অন্যের অন্যায় আবদার মেটানো। বয়স যা ই হোক না কেন প্রেমে পড়া মাত্র মানুষ টিনেজারের মতো আচরণ করেন। ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে পাগলামি করুন কিন্তু মানসিকভাবে দৃঢ় থাকুন যেনো আপনাকে ঠকতে না হয়। ভালোবাসতে হবে শর্তহীনভাবে। কার বাবার কি আছে, ক্যারিয়ার কেমন, বাহ্যিক সৌন্দর্য এগুলো সম্পর্কের মানদণ্ড নয়। কারণ সবকিছু অস্থায়ী। দুজনের ভালোবাসা মজবুত হলে দুজনে একসাথে বুড়ো হওয়া যায় কোনো প্রকার চাওয়া পাওয়া ছাড়া শান্তির সংসার করা যায়। 

প্রেম আসক্তিই বটে এবং না পেলে মন লাগামহীন ঘোড়ার মতোই আচরণ করে। মনকে মাস্কে আটকানো যায় না লাগামও দেয়া যায় না। খুঁজতে হয় ঠিক সঙ্গী। সুখে দুঃখে সংগ্রামী জীবনে যে সাথী হবে সেই আপনার প্রকৃত সঙ্গী। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি যেনো কখনো সবচে বড় শত্রু হয়ে না উঠে। বিশ্বাস ভালো লাগা ভালোবাসায় আর বোঝাপড়ায় কাটিয়ে দেয়া যায় সাধারণ জীবন। নৈতিকতা, ধর্মীয়চর্চা, মানবিকতাবোধ জীবনকে সুন্দর করে। সুস্থ সফল সম্পকের্র একটা বড় ওয়াদা থাকা চাই প্রিয়জন যেনো হয় না কেবল প্রয়োজন।



Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫