স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের সুখের রহস্য কি

২০১২ সালে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (SDSN) গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে আসছে বিশ্বসংস্থাটি। এ তালিকায় উপরের দিকে থাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের দেশসমূহ, যার প্রতিফলন দেখা যায় সর্বশেষ ২০২৩ সালের রিপোর্টেও।

ভৌগলিকভাবে ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে ও সাংস্কৃতিকভাবে এই তিনটিসহ আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও ফারো দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ। এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সুখের কারণ কী? এসব নিয়েই আজকের আলোচনা।

আলোচনার শুরুতেই জানা প্রয়োজন ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট কী? আর কীভাবেই বা তৈরি হয় সুখী দেশের তালিকা।

মূলত, বিভিন্ন বিষয়কে মাথায় রেখে তৈরি করা হয় ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন। মোটাদাগে দুটি সূচক ব্যবহৃত  হয়- সাবজেক্টিভ ও অবজেক্টিভ। সাবজেক্টিভ সূচকে SDSN সেই দেশের মানুষের নিজস্ব মূল্যায়নকে দেখার চেষ্টা করে। আর অবজেক্টিভ সূচকের মধ্যে SDSN দেখে থাকে- ১) পার ক্যাপিটা জিডিপি (মাথাপিছু আয়), ২) স্বাস্থ্য বা সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল, ৩) সামাজিক সহযোগিতা, ৪) জীবন পছন্দ করার স্বাধীনতা, ৫) উদারতা, এবং ৬) দুর্নীতি নিয়ে মানুষের উপলব্ধি।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা এত সুখী কেন?

মানুষ কী কারণে সুখী হয়? মানুষ কোনো একক কারণে সুখী হয় না। বিরূপ আবহাওয়ার পরও স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের সুখ সূচকে এগিয়ে বা এত সুখী হওয়ার রয়েছে বিভিন্ন কারণ। সেগুলো ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা

মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। এই অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের সংবিধান। একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামরিক সরকারের সময়ে সংবিধান মূলত অকার্যকর। সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকার। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে সরকারব্যবস্থা সোশ্যাল ডেমোক্রেসি। উল্লেখিত ৬টি ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে বেশিরভাগ এই সরকারব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি থাকায় মানুষের সামাজিক সুরক্ষা অত্যন্ত শক্তিশালী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ফ্রিসহ মৌলিখ অধিকার নিয়ে চিন্তা করতে হয় না জনগণকে।

নায্যতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা

সমাজ যদি সমতা ও নায্যতাকে প্রাধান্য না দেয়, তাহলে সেই সমাজের মানুষেরা কম সুখী হতে পারে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের সমাজব্যবস্থায় যা লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক সহযোগিতা, উদারতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ এগিয়ে। একটি শিশু যখন নর্ডিক দেশে জন্ম নেয়, তার দায়িত্ব সরকারও নেয়। ফ্রি স্কুল, ফ্রি চিকিৎসা পেয়ে থাকে দেশের সকল নাগরিক। সামাজিক সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে চ্যারিটি, অন্যের উপকার। একজন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নাগরিক দিনশেষে চিন্তা করবে আমি কি চ্যারিটিতে দান করেছি? এই চ্যারিটির মাধ্যমে একজন মানুষ মানসিক শান্তি পেয়ে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে পরোপকারের মাধ্যমে তারা মানসিক শান্তি পেয়ে থাকে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য সরকারের সহযোগিতা থাকে। শিক্ষার পর কেউ যদি চাকরি চলে যায়, রাষ্ট্র তার সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে থাকে।

অর্থনীতি

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করার দরুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে থাকে, পাশাপাশি দেশসমূহ সামজিক কল্যাণ প্রোগ্রামের উপর জোর দেয়, যেমন- সার্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধা। যার ফলে সেখানে আয়বৈষম্য, বিভেদ কম। একজন অশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান চাইলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে ফ্রিতে। রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে আয়বৈষম্য কম থাকার দরুন মানুষের মধ্যে হতাশা কম কাজ করে।

উদারতার সংস্কৃতি

সংস্কৃতি মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় একটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিশু যে সংস্কৃতি রপ্ত করে তা তাদের সুখী জাতিতে পরিণত করে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের মধ্যে স্বাধীনতার অনুভূতি (sense of freedom) রয়েছে। ৪ নাম্বার ক্রাইটেরিয়াতে যার কথা বলা হয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি ইত্যাদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের সুখী বোধ করতে সাহায্য করে। জনগণের নিরাপত্তা রয়েছে সর্বোচ্চ।

মূলত, এসকল কারণই স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের বিশ্বের মধ্যে সুখী জাতিতে পরিণত করেছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //