
ঈদ-এ মিলাদুন্নবীর মিছিল। ছবি: সংগৃহীত
পদ্মা-মেঘনায় সশব্দে বৈঠা মেরে এগিয়ে যায় মাঝি-ধানের ক্ষেতে নিড়ানি দেয় কৃষক-নজরুলের নাতে রাসুল তারা আনমনে গেয়ে ওঠেন- ‘মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে তাই কিরে তোর কণ্ঠেরি গান, (ওরে) এমন মধুর লাগে...’
দমকা হাওয়ায় সে কণ্ঠ ভেসে যায় বহু দূরে, কোনো মসজিদের মিলাদ মাহফিলে সে সুর টেনে নেন ইমাম...। গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দরে অগণিত রাসুলের দিওয়ানার দিলে খুশির বন্যা বয়ে যায় ১২ রবিউল আউয়ালে। রাসুলের জন্মদিন ছুঁয়ে গেল সদ্যই, উৎসবের আমেজ বয়ে গেছে দেশজুড়ে, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন জায়গায়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেটের কিছু অঞ্চলে ১২ রবিউল আউয়াল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় এখনও। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য জায়গা তো রয়েছেই। এই দিনকে কেন্দ্র করে প্রার্থনা, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের সঙ্গে আনন্দ শোভাযাত্রাও বের করা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিবস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন তারিখে রাসুলে করিম (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। অনেকের মতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছেন- আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে ৯ রবিউল আউয়াল। ইবনে আবু শাইবা তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে সাহাবি জাবের (রা.) ও সাহাবি ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) হাতিবাহিনীর মক্কা আক্রমণের বছর- ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন।
আল্লামা শিবলী নোমানী ও সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.) প্রণীত সিরাত-গ্রন্থ ‘সিরাতুন্নবী’-তে বলা হয়েছে, নবী করিম (সা.)-এর জন্মদিবস সম্পর্কে মিশরের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা এক পুস্তিকা রচনা করেছেন। এতে তিনি বলছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম ৯ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার, ২০ এপ্রিল ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। মাহমুদ পাশা যে প্রমাণ-পত্র দিয়েছেন তা কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী বিস্তৃত। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত বার্ষিকী ১২ রবিউল আউয়ালের ক্ষেত্রে সকল ঐতিহাসিক একমত পোষণ করেন। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিবস ‘ঈদ-এ মিলাদুন্নবী’ নামে পালিত হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা এটি ‘নবী দিবস’ নামে পালন করে। ‘ঈদ-এ মিলাদুন্নবী’ পালন নিয়ে মুসলমান পণ্ডিতগণের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশে এটি রাষ্ট্রীয়ভাবেই পালিত হয়ে আসছে।
এ দিন সারা দেশে সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ঈদ-এ মিলাদুন্নাবী- ইসলাম ধর্মাবলম্বী রয়েছে এমন প্রায় সব দেশেই পালিত হয়। উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে এমন দেশ যেমন- ইথিওপিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, কোট ডিলভোয়ার, ইরাক, ইরান, মালদ্বীপ, মরক্কো, জর্ডান, লিবিয়া ইত্যাদি। তবে ব্যতিক্রম হলো সৌদি আরব ও কাতার। দেশ দুটিতে দিনটি সরকারি ছুটি নেই এবং আড়ম্বরপূর্ণ কোনো আয়োজন হয় না।
তুরস্কে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়েই পালিত হয় মিলাদুন্নবী। তুর্কিরা দিনটিকে মেভলিড কান্দিলি বলে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে রচিত ঐতিহ্যবাহী কবিতাগুলো মসজিদে আবৃত্তি হয় এবং সন্ধ্যায় তুর্কিরা নিজ বাড়িতেও এ আয়োজন করে। সুন্নি মুসলমান অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ার বেশকিছু অংশে মিলাদুন্নবী উদযাপনের গুরুত্ব, জাঁকজমকতা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবকেও ছাড়িয়ে যায়।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপপুঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী কেন্দ্রিক উৎসবকে সিকাতেন বলা হয়ে থাকে। সিকাতেন বা মিলাদুন্নবী- সেখানে বিশেষ আয়োজন লক্ষ করা যায়। সিকাতেনের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে, জাকার্তার শাসক সুলতান হামেং কুবুওয়ানারের আমলে এ উৎসবের প্রচলন হয়। জাকার্তাসহ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সিকাতেন বা ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী উৎসব আয়োজিত হয়। দিনটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মসজিদ ও বাসাবাড়িতে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় স্মরণ করা হয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে। এ উপলক্ষে রাতভর মেলার আদলে রাস্তাঘাট ও বাজারে বেচাকেনা চলে। নারিকেল, বাদাম, চিংড়ি ও মরিচের সংমিশ্রণে বিশেষ ধরনের ভাত রান্না হয়, যা স্থানীয়ভাবে সিগোগরিই নামে পরিচিত। দিনটিতে এই খাবার পরিবারসহ সকলে এক সঙ্গে খেতে পছন্দ করে।
উপমহাদেশে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম দিবসটি আলাদামাত্রা যোগ করে আসছে শত শত বছর ধরে। মতানৈক্য থাকলেও রাসুলের প্রেমে মশগুল ধর্মপ্রাণমুসলিমরা এই দিনটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে থাকেন।