
দেবী দুর্গার মূর্তি। ছবি: সংগৃহীত
‘আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে
রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জীবন
ত্রাহি-আনান নন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে-মৃন্ময়ীকে আবাহন।’
মহালয়া বলতেই কানে বাজে শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ নামে পরিচিত স্তোত্রপাঠ, যা শোনার জন্য প্রত্যেক সনাতন বাঙালি পরিবার ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে। এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং ঘোর অমানিশা দূর হয়ে শুক্লপক্ষে আলোকময়ী দেবীপক্ষের শুভসূচনা হয়। ‘মহালয়া’ শব্দটির অর্থ- মহান যে আলয় বা আশ্রয়। মহালয়া থেকেই দেবী দুর্গার আবাহন মুহূর্তটি চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই অনেকের মতে দেবী স্বয়ং হলেন এই আলয় বা আশ্রয়। এই বিশেষ দিনেই মহিষাসুর তথা অশুভ শক্তির কবল থেকে দেবগণকে উদ্ধার করার জন্য পরমা প্রকৃতি দেবী দুর্গা উদ্যত হয়ে ওঠেন। এর ছয় দিন পর সূচনা হয় মহাসপ্তমীর।
দেবীর চক্ষুদান ও অকাল-বোধন
মনে করা হয়, দুর্গাপূজার সূচনা হয় দেবীর চক্ষুদানের মাধ্যমেই। রামায়ণ অনুসারে রাবণ বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা শুরু করেন, যা বর্তমানে বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। শ্রীরামচন্দ্র পরবর্তীকালে রাবণকে পরাস্ত করতে শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন, যা অকালবোধন নামেও পরিচিত।
পুরাণ মতে, সূর্যের উত্তরায়ণ হচ্ছে দেবতাদের দিন। উত্তরায়ণে তথা বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমেই উত্তর দিকে গমনে সময় লাগে ছয় মাস। এই ছয় মাস দেবতাদের এক দিনের সমান। দিনের বেলায় জাগ্রত থাকেন দেবতারা। তাই দিনেই দেবতাদের পূজা করা শাস্ত্রের বিধান। অন্যদিকে সূর্যের দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত। দক্ষিণায়নে তথা বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমেই দক্ষিণে গমনকালের ব্যাপ্তি ছয় মাস। দক্ষিণায়নের ছয় মাস দেবতাদের এক রাতের সমান। শরৎকাল দক্ষিণায়নের সময় তথা দেবতাদের রাত্রিকাল। স্বাভাবিকভাবেই এই সময় দেবতারা ঘুমান। রাতে পূজার বিধান নেই শাস্ত্রে।
তাই শরৎকাল পূজা-অর্চনার উপযুক্ত কাল নয়- ‘অকাল’। অকালে দেবতার পূজা করতে হলে তাকে জাগ্রত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটিই হলো ‘বোধন’। এই অকালে শ্রীরামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাক্ষসরাজা রাবণকে পরাজিত করতে শক্তিসঞ্চারে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজাকে দেবী দুর্গার অকালবোধন বলে। আর এ সময়টি শরৎকাল বিধায় শারদীয়া পূজাও বলা হয়ে থাকে।
মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমায় চোখ আঁকা হয় এবং প্রতিমাসহ মণ্ডপ সাজানো হয়। প্রতিমা তৈরির কারিগররা আগে থেকেই কাজ শুরু করলেও মহালয়ার দিন প্রতিমাকে চূড়ান্ত রূপ দেন। আর এটাই প্রথা হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। মহালয়ার দিনে পিতৃপক্ষ শেষ হয় এবং এই দিন থেকে দেবীপক্ষ শুরু হয়।
প্রচলিত ভিন্নমত : পিতৃগণ তথা সর্বভূতে তর্পণ
সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পিতৃগণের জন্য, সঙ্গে পুরো জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা। রামচন্দ্র লংকা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন।
কথিত আছে- পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনালগ্নের এই বিশেষ সন্ধিক্ষণ মানব জীবনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়া থেকেই দেবী দুর্গার আবাহন মুহূর্তটি চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই অনেকের মতে দেবী স্বয়ং হলেন এই আলয় বা আশ্রয়। ভিন্নমতে, এই মহান আলয় হলো পিতৃলোক। জনশ্রুতি আছে- পিতৃপক্ষের এক পক্ষকাল পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসে। ওই সময় সেসব আত্মারা জল ও তিল পাওয়ার আশায় বসে থাকেন। পৌরাণিক কাহিনি মতে, ব্রহ্মার নির্দেশেই গড়ে ওঠে এই মহামিলনক্ষেত্রটি। শাস্ত্রমতে, হিন্দুদের অবশ্য পালনীয় যে পঞ্চমহাযজ্ঞের বিধান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো পিতৃযজ্ঞ অর্থাৎ তর্পণাদি। এই তর্পণ কথাটির অর্থ হলো- আত্মার তৃপ্তির উদ্দেশ্যে জলদান। তবে তর্পণ তাই শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই হয় না, সর্বভূত তথা সব জীবের উদ্দেশ্যেই করতে হয়।
তাই সনাতনী শাস্ত্রবিশেষজ্ঞরা বলেন, পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যা পেরিয়ে জগত যখন আলোকোজ্জ্বল দেবীপক্ষে আগমন করে, তাই সেই মহা-লগ্নই আসলে ‘মহালয়া’।