
পুরস্কার নিচ্ছেন তরুণ হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের তরুণ হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ, ইসলামী বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে পুরো দেশকে গর্বিত করেছেন। তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত নবম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় তার এই সাফল্য দেশীয় কোরআন শিক্ষা ও হিফজুল কোরআনের প্রতি বাংলাদেশের অবদানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
গত ৩০ অক্টোবর, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের হাত থেকে দেশটির ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মুখে মুয়াজ মাহমুদ এই সম্মাননা গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের পর এই প্রথম তুরস্কে বাংলাদেশির হাতে এই পুরস্কার উঠেছে, যা বাংলাদেশের কোরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।
ছোট্ট মুয়াজের বড় স্বপ্ন
হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ ২২ আগস্ট ২০০৬ সালে চাঁদপুর জেলার বালিয়াবাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। পিতা মোহাম্মদ আলী একজন ব্যবসায়ী এবং মা-বাবার কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়।
স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে মুয়াজ ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত মারকাজু ফয়জিল কোরআন আল ইসলামী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাত্র তিন বছরের মধ্যে হাফেজ হয়ে ওঠেন এবং বর্তমানে ওই মাদ্রাসায় কাফিয়া (নবম) শ্রেণির ছাত্র।
সাফল্যের পথে
মুয়াজের মেধা ও অধ্যবসায়ই তাকে এই অগ্রগতি অর্জনে সাহায্য করেছে। গত ২৮ মার্চ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধায়নে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতার বাছাইপর্বে দেশের শত শত মেধাবী হাফেজদের পেছনে ফেলেই মুয়াজ তুরস্কের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।
বিশ্ব মঞ্চে আরো সাফল্য
মুয়াজ মাহমুদ শুধু তুরস্কেই নয়, এই বছর পবিত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত কিং আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায়ও সাফল্য অর্জন করেন। ২১ আগস্ট, মক্কায় ১২৩টি দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় তিনি ১৫ পারা গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তার এই অসাধারণ সাফল্য বাংলাদেশের কোরআন শিক্ষার জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৩ সালে ৪৬তম কেন্দ্রীয় বেফাক পরীক্ষায়ও মেধাতালিকায় স্থান অর্জন করেছিলেন মুয়াজ।
বিজয়ের পর মুয়াজের প্রতিক্রিয়া
বিশ্বজয়ী হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ তার সাফল্যকে আল্লাহর রহমত এবং কোরআনের মর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি বলেন, ‘এটা আমার মর্যাদা নয়, এটা মহান আল্লাহর কোরআনের মর্যাদা। মহান আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন, তাই আমার জন্য এই জয় সহজ হয়েছে।’ তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন যেন, ‘দুনিয়াতে যেভাবে প্রথম হয়েছি, তেমনই জান্নাতুল ফেরদাউসে একসঙ্গে থাকতে পারি।’
দেশে ফিরে গর্বের মুহূর্ত
তুরস্কে কোরআন হিফজ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে দেশে ফিরে আসার পর মুয়াজ মাহমুদকে সংবর্ধনা জানাতে ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করা হয়। বিমানবন্দর থেকে ওই বাসে করে তাকে তার মাদ্রাসায় নিয়ে আসা হয়, যেখানে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়।
মুয়াজের স্বপ্ন, ভবিষ্যতে আল্লাহর দ্বিন শিখে একজন যোগ্য আলেম হয়ে পবিত্র কোরআনের খেদমত করা। বিশ্বজয়ের পর তিনি তার পুরস্কারটি তার মা-বাবার জন্য উৎসর্গ করেন, যাদের অশেষ দোয়া ও প্রেরণা তাকে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
মাদ্রাসার ভূমিকা
মুয়াজ মাহমুদ ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত ‘মারকাজু ফয়জিল কোরআন আল ইসলামী’ মাদ্রাসার ছাত্র, যেখানে তিনি হিফজুল কোরআন শিখেছেন। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসা এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে বহু আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় সফলতা অর্জন করেছে। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, গুলশান সোসাইটি জামে মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা মুফতি মুরতাজা হাসান ফয়েজী মাসুমের নেতৃত্বে মাদ্রাসাটি আজ কোরআন শিক্ষার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। হাফেজ মুয়াজ মাহমুদের এই সাফল্য বাংলাদেশে কোরআন ও ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই বিজয় শুধু তার নিজের নয়, বরং পুরো দেশের জন্য এক গর্বের মুহূর্ত। তার অগ্রযাত্রা ভবিষ্যতে আরো অনেক তরুণকে অনুপ্রাণিত করবে, যাতে তারা তাদের জীবনকে আল্লাহর কোরআন ও ইসলামের খেদমতে নিবেদিত এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো শক্তিশালী করতে পারে।