Logo
×

Follow Us

ধর্ম

রমজানের শিক্ষা সংযম ও সহিষ্ণুতা

Icon

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৪০

রমজানের শিক্ষা সংযম ও সহিষ্ণুতা

প্রতীকী ছবি

অফুরন্ত রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের অমিয় বারতা নিয়ে আগমন করেছে সিয়াম আদায়ের মাস রমজানুল মোবারক। এ বছরের  রমজান মাসের আজ  ১২ তারিখ। সিয়ামের মাসটির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, এটি সবরের মাস। আর সবরের প্রতিদান জান্নাত।

সবর বা সহিষ্ণুতা মানবজীবনের একটি উন্নত গুণ। সবরের আভিধানিক অর্থ নিজেকে আবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণকে সবর বলা হয়। ইবাদত করতে গিয়ে যে কষ্ট, নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে যে কষ্ট এবং বিপদের সময়ে যে কষ্ট হয়, তা সহ্য করার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নাম সবর। আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন অনেক সময় প্রবৃত্তির চাহিদার খেলাপ হয়। তখন নিজেকে সংযত রেখে সঠিক নিয়মে সেই আদেশ পালন করা  ঈমানের দাবি। যেমন- ভোরে ঘুমের প্রাবল্য সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে ফজরের নামাজের  জন্য উঠতে হয়। গভীর রাতের আরাম ত্যাগ করে যারা তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য ওঠেন, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত নাজিল হয়। এভাবে শরীয়তের যেসব নির্দেশ পালন করতে গিয়ে প্রবৃত্তির সঙ্গে বিরোধিতা করতে হয়, সেগুলোতে প্রমাণিত হয় ঈমানের দৃঢ়তা।  নিষিদ্ধ কাজগুলো সাধারণত লোভনীয় হয়ে থাকে। 

হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, জান্নাতকে বেষ্টন করে আছে প্রতিকূলতাগুলো। আর জাহান্নামকে ঘিরে রেখেছে লোভনীয় বিষয়গুলো। অতএব নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে নিবৃত্ত থাকা আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতিরই ফল। তেমনি বিপদের সময় অবিচলিত থাকা মুমিনের অন্যতম উন্নত আদর্শ। এভাবে  নিজেকে রব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ও হুকুমের কাছে সোপর্দ করা প্রকৃত ঈমানের দাবি। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, জেনে রেখ, তুমি যা পেয়েছ তা তোমার থেকে এড়িয়ে যাওয়ার ছিল না। আর তোমা থেকে যা এড়িয়ে গেছে, তা তোমার পাওয়ার ছিল না। অবশ্য সবরের আরো ক্ষেত্র রয়েছে।

উত্তেজনার  সময়ে মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা করাও সবরের অন্তর্গত। সমালোচনা সহ্য করাও সবর। নিন্দুক বা সমালোচক সত্যের আশ্রয় নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবুও অস্থির না হয়ে নিজ কর্তব্য ও আদর্শে স্থির থাকার শিক্ষা দেয় ইসলাম।

মাহে রমজান সবরের গুণ অর্জনে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পানাহার বর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের প্রবৃত্তি দমনের যে অভ্যাস গড়ে ওঠে, তা যখন অন্যসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, তখন একজন মানুষের চরিত্র হয় উন্নত থেকে আরো উন্নত। নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধনে মাহে রমজান এভাবেই প্রভাব ফেলে। সবরের মাহাত্ম্য ও প্রতিদান সম্পর্কে প্রচুর আয়াত ও হাদিস রয়েছে। যেমন- সুরা জুমারের ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের  প্রতিদান অভাবনীয় মাত্রায় দেওয়া হবে।

ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে টিকে থাকতে হয়েছে। ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাদের উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। আল্লাহর রাসুল এই ক্ষুদ্র দলটিকে ঈমানের উপর অটল রাখতে আগের যুগের নবীদের ও তাদের নিষ্ঠাবান অনুসারীদের ওপর বয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতার ঘটনা বর্ণনা করেছেন।  এ প্রসঙ্গে হজরত খাব্বাব (রা.) থেকে বর্ণনা রয়েছে, যা প্রায় সব হাদিসের গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। তিনি বলেন, কাফেরদের অত্যাচারে  অতিষ্ঠ হয়ে আমরা আল্লাহর রাসুলের কাছে গেলে তিনি আমাদের বলেন, আগের যুগের নবীদের ও তাদের অনুসারীদের ওপর আরো কঠিন  পরিস্থিতি এসেছিল। তবুও তারা অস্থির হননি।  অথচ তোমরা অস্থির হয়ে পড়ছ।  সেই কঠিন অবস্থায় তারা টিকে ছিলেন বলেই পরে ইসলামের প্রসার হয়েছে। আর সেই প্রথম যুগের  একেকজন মুসলমান হয়েছেন মহাপুরুষ। তারা শুধু কাফেরদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিলেন না, পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। তবুও ঈমান ও আমলে সালেহের ক্ষেত্রে তারা বিন্দুমাত্র শৈথিল্য দেখাননি।

মাহে রমজান আমাদের এই সহিষ্ণুতা অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। সিয়াম বা রোজা রাখা অবস্থায় শুধু পানাহার ও কামাচার থেকে নিবৃত্ত থাকা নয়, পাপাচার থেকেও নিবৃত্ত থাকতে হয়।  কোনো মুসলমান যদি শুধু এতটুকু পালন করে তবুও  তার ফরজ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সিয়ামের তাৎপর্যের পরিপন্থি। সিয়ামের পূর্ণতার জন্য পানাহার ও কামাচার বর্জনের পাশাপাশি পাপাচার থেকেও বিরত থাকতে হয়। এটাও সিয়ামের দাবি।

এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বরাতে একটি হাদিস  সঙ্কলন করেছেন ইমাম তিরমিজি রহমাতুল্লাহি আলায়হি। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, রোজা রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও অন্যায় আচরণ পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ এমন রোজা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। 

কিন্তু যার পক্ষে পাপাচার বর্জন সম্ভব হয় না কিংবা যে ব্যক্তি রোজা রেখেও অন্যায় কাজ করে, তাকে কী পরামর্শ দেওয়া যায়? তার রোজার পরিণতি কী হবে?  যেমনÑগিবত বা পরচর্চা  একটি পাপাচার। রোজাদার গিবতের পাপে লিপ্ত হলে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে কি? প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ আধ্যাত্মিক সাধক হজরত সুফিয়ান সওরী (রহ.) অভিমত ছিল গিবতের কারণে রোজা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি ইমাম গাযযালী (রহ.) তার অমর গ্রন্থ এহয়াউল উলুমে প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হজরত মুজাহিদ ও হজরত ইবনে সীরীনের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, গিবত রোজা নষ্ট হওয়ার কারণ। এসব মনীষী প্রথমত হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। দ্বিতীয়ত, তারা যুক্তি দেন, পানাহার মৌলিকভাবে হালাল। অথচ রোজার কারণে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যাচার, গিবত ইত্যাদি কখনই বৈধ নয়। রোজায় এসবের কদর্যতা আরো বেড়ে যায়। রোজা রেখে এগুলোতে লিপ্ত  হওয়া আরো গুরুতর অন্যায়। সুতরাং মৌলিকভাবে হালাল ও বৈধ পানাহার যদি রোজা নষ্টের কারণ হয়, তাহলে যেসব কাজ কোনো অবস্থায়ই বৈধ নয়, তাতে লিপ্ত হওয়ার কারণে রোজা নষ্ট হওয়া খুবই যুক্তিসংগত। 

হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এ ব্যাপারে একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, রোজার একটি কাঠামোগত স্বরূপ রয়েছে। তেমনি রয়েছে একটি উদ্দেশ্যগত স্বরূপ। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার বর্জন রোজার কাঠামোগত স্বরূপ। সেই অনুযায়ী রোজায় পানাহার  যদিও লঘু অন্যায়, কিন্তু তা কাঠামোগত স্বরূপের পরিপন্থি। আর পাপাচার যদিও গুরুতর অন্যায়।  কিন্তু তা রোজার কাঠামোগত স্বরূপের পরিপন্থি নয়। রোজার উদ্দেশ্যগত স্বরূপ হলো পানাহারের পাশাপাশি পাপাচার বর্জন করা। সুতরাং গুনাহের কাজ রোজার উদ্দেশ্যগত স্বরূপের খেলাপ। তাই অন্যায় কাজ ও আচরণের কারণে রোজার উল্লেখযোগ্য সুফল থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। অতএব এমন বিভ্রান্তিতে পড়া যাবে না,  যে ব্যক্তি পাপাচার বর্জনে অক্ষম, তার রোজা রাখা অনর্থক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫