
রুনীগাঁও মসজিদ। ছবি: শেরপুর প্রতিনিধি
শেরপুরের নকলায় রুনীগাঁওয়ের অলৌকিক ও ঐতিহাসিক মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এখনো কালের সাক্ষী বহন করে আসছে। মসজিদ ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক ও কল্প কথা। এটি শেরপুর জেলার নকলা উপজেলা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গৌড়দ্বার ইউনিয়নে অবস্থিত।
জনশ্রুতি রয়েছে তৎকালীন এক রাতে অপরিচিত কয়েকজন শ্রমিক ওই মসজিদটি নির্মাণকাজ শুরু করেন। ওই রাতে পার্শ্ববর্তী বাড়ির এক মহিলা প্রকৃতির ডাকে বাড়ির বাইরে বের হলে তা দেখে ফেলেন। এ সময় ওই লোকজন মহিলাকে বলেন, কথাটা বাড়ির কাউকে যেন না বলেন। কিন্তু মহিলাটি বাড়ির ভেতরে গিয়েই তার স্বামীকে ঘটনাটি বলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা মসজিদটির কাছে গিয়ে কাউকে দেখতে পান না, এর মধ্যে মসজিদটির নির্মাণকাজ চার-পাঁচ ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে। আবার কারো কারো মতে, ওই রাতে কারুকাজ খচিত মসজিদটি অলৌকিকভাবে মাটির নিচ থেকে উঠতে থাকলে এক মহিলা তা দেখে ফেলেন এবং তা বাড়ির পুরুষদের দেখাতে ডেকে আনেন। এর পর থেকেই মসজিদটি সম্পূর্ণভাবে ওঠা বন্ধ হয়ে যায় এবং তা আজ পর্যন্ত ওই চার-পাঁচ ফুট পর্যন্তই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রুনীগাঁও গ্রামের নামটি নিয়েও এলাকাবাসীর মধ্যে রয়েছে ভিন্ন মত। কারো মতে, মোগল আমলে মসজিদটি জেগে ওঠার আগে রুনী বেগম নামে এক মহিলা লোকজনসহ দিল্লি থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় এখানে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে মারা যান। এরপর তাকে এখানেই কবর দেওয়া হয়। তার নামানুসারেই এই জায়গার নামকরণ হয় রুনীগাঁও। যদিও আজ পর্যন্ত ওই কবরের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
আবার কারো কারো মতে, যার নামানুসারে শেরপুরের নামকরণ, সেই শের আলী গাজী এখানে মাঝেমধ্যে এসে বিশ্রাম নিতেন।
অথবা তৎকালীন হিন্দু জমিদারের এক আদেশে শের আলী গাজীর প্রাণ দণ্ডাদেশ হলে এই মসজিদে তিনি কিছুদিন অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। এ থেকেই এ স্থানের নাম হয় গাজীর দরগা মসজিদ। আজ পর্যন্ত এই স্থানের নাম কেউ বলেন রুনীগাঁও মসজিদ আবার কেউ বলেন গাজীর দরগা মসজিদ। তবে জায়গাটির নামের বিতর্ক শেষ না হলেও মসজিদটি যে মোগল আমলের অন্যতম কীর্তি, তার প্রমাণ মিলেছে।
সঠিকভাবে দিন-তারিখ জানা না গেলেও মোগল আমলে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গড়জরিপা বারো দুয়ারী মসজিদ, ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাগড়া লস্কর খান মসজিদ, শেরপুর শহরের কসবার কাজীর গলি মসজিদ ও সদর উপজেলার গাজীর খামারের গাজীর দরগার মসজিদের ইটগুলোর সঙ্গে হুবহু মিল থাকায় এ ধারণা করা হচ্ছে। মসজিদটি জেগে ওঠার পরও স্থানীয় লোকজনের মুখে নানা অলৌকিক ঘটনার কথা শোনা গেছে। মসজিদটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে কুর্শা বিল। এ কুর্শা বিল থেকে মসজিদ পর্যন্ত একটি গভীর খাল ছিল। যার নিদর্শন এখনো কিছুটা রয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, যারা ওই মসজিদে সিন্নি মানতের চাল-ডাল নিয়ে আসত, তখন ওই খালের পানিতে হাঁড়ি, পাতিল, চামচ ইত্যাদি ভেসে উঠত এবং তা দিয়ে সিন্নি রান্না শেষে ওই জিনিসপত্র খালের পারে ফেরত দিত। কেউ যদি ওই সব জিনিসপত্রের একটি রেখে দিত তবে তার কঠিন অসুখ হতো। পরে তা ফেরত দিলে সে সুস্থ হয়ে উঠত। এলাকাবাসী আরো জানায় যে এমনো ঘটনা ঘটেছে যে যদি কোনো ব্যক্তি ওই মসজিদের পরিত্যক্ত কোনো ইট বা সুরকি লুকিয়ে বাড়ি নিয়ে যেত তবে সে অসুস্থ বোধ করত এবং তা পুনরায় ফেরত দিলে সুস্থ হয়ে যেত। এসব নানা ভয়ে এলাকাবাসীর কেউই মসজিদটির গায়ে হাত বা সংস্কার না করে বর্তমানে ওই মসজিদটির পাশেই আরো একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
পুরাতন মসজিদের যেসব ইট দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে, সেগুলোর কিছু নতুন মসজিদে লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে আসল মসজিদটি রক্ষার জন্য চারপাশে প্রাচীর করে তা সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে স্থানীয় এলাকাবাসী। খোলা অবস্থায় মসজিদটিতে একসময় এলাকাবাসী জুমা ও ওয়াক্তের নামাজ পড়ত। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে পাশের মসজিদ নির্মাণ করা হয় বলে এলাকাবাসী জানায়।
বর্তমানে পুরাতন ওই মসজিটির সামনে টিনের চালার নিচে দূর-দূরান্তের দর্শনার্থী ও ভক্তরা এসে টাকা-পয়সাসহ মোমবাতি, আগরবাতি দিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখার দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় এক খাদেম। এখানে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ শুক্রবার উদযাপন করা হয় ওরসের। এতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর ভক্তপাগল ও দর্শনার্থীরা এসে ভিড় জমায়।