
ভারতীয় ধর্মগুলোর মধ্যে শিখধর্ম একটি ধর্ম যার উৎপত্তি ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে। এই ধর্ম ও মতের অনুসারীদেরকে শিখ এবং শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। খ্রিস্টীয় ১৫ শতকে গুরু নানক শাহীর মাধ্যমেই এ ধর্মের যাত্রা শুরু হয় ও ধীরে ধীরে শিখধর্ম ও সম্প্রদায় বিকাশ লাভ করতে থাকে। গুরু নানক দেব শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম ধর্মগুরু।
গুরু নানক ১৫ এপ্রিল ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম পাঞ্জাবের অন্তর্গত লাহোরের রায় ভোয় কি তালওয়ান্দি গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে জায়গাটি পাকিস্তানে অবস্থিত যার নাম হলো নানকানা সাহিব। প্রতিবছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তাঁর জন্মোৎসব পালিত হয়ে থাকে। তাঁর বাবার নাম মেহতা কল্যাণ দাস বেদী। সবাই তাকে মেহতা কালু নামে ডাকতেন। তাঁর মায়ের নাম তৃপ্তা দেবী।
ছোটোবেলা থেকেই নানক তাঁর সমবয়সী অন্য শিশুদের মতো ছিলো না। তিনি একা একা নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন ও গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার পর তাঁর শিক্ষক গোপাল পণ্ডিতের কাছে তিনি বলেন ঈশ্বর ও ধর্মকথা ছাড়া আর কোনো কিছুই তাঁর ভালো লাগে না। গোপাল পণ্ডিতের কাছেই তিনি মাতৃভাষা শিক্ষা করেন। পাঠশালার পড়া শেষ হওয়ার পর সংস্কৃত ভাষা শেখার জন্য তাকে ব্রিজনাথ শবমা নামে এক পণ্ডিতের কাছে পাঠানো হয়। ওই সময়ে জমিদারী সেরেস্তার কাজকর্ম পেতে হলেও ফারসি ভাষা জানা লাগতো তাই তাঁর পিতা মেহতা কালু তাকে ফারসি শেখার জন্য এক মৌলভীর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু নানক সবসময় ঈশ্বরের ও ধর্মের কথায় বিভোর থাকায় মাঝপথে ফারসি ভাষা শেখার ইতি টানেন।
সুলতান দৌলত খাঁ লোদীর দেওয়ান জয়রাম ছিলেন নানকের ভগ্নীপতি। তাঁর প্রচেষ্টায় সুলতান নানকে গুদামঘর দেখাশোনার কাজে নিয়োগ দেন। এখানেও তিনি সবসময় গভীর আধ্যাত্মিক চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। নানক বিবাহিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সুলক্ষ্মী। নানকের শ্রী চাঁদ ও লক্ষ্মী দাস নামে দুই সন্তান ছিলো। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে মানুষের মাঝে তিনি একেশ্বরবাদের মতবাদ প্রচার করেন। ঈশ্বরের প্রেম ব্যক্ত করার জন্য নানকের মধ্যে এক কবিত্বশক্তি জাগ্রত হয়েছিল। তিনি অনেক ভজন রচনা করেছেন। আধ্যাত্মিক জগতের এই ভজনগুলো 'জপজী' নামক গ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে।
গুরু নানক বলেন : 'হিন্দু বা মুসলমান এগুলো পরিচয় নয়,মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ।' তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই ছিল। সব ধর্মমতের মানুষই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পুরো ভারত ,দিল্লী, কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, কাশ্মীর, বাংলা ছাড়াও মক্কা, মদীনা,প্যালেস্টাইন,বাগদাদ, শ্রীলঙ্কা,তিব্বত ভ্রমণ করেন। বহু বছর পরিভ্রমণের পর তিনি দেশে এসে কর্তারপুর গ্রামে ফিরে যান এবং জীবনের বাকি দিনগুলো এখানেই অতিবাহিত করেন। সেই সাথে ধর্মমত প্রচার করেন। তাঁর প্রচলিত ধর্মমত ছিল সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর। তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তিনি তাঁর সময়কালে লঙ্গরের প্রচলন করেন ও তাঁর শিষ্যরা একত্রে বসে আহার করতেন। নানক ২২ সেপ্টেম্বর ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন।
পৃথিবীর সব ধর্মের মতো শিখ ধর্মেরও রয়েছে ধর্মীয় গ্রন্থ যার নাম 'গ্রন্থ সাহিব'। ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলই মূলত শিখদের প্রাচীন ও মূল আবাসস্থল। সেখানেই অধিকাংশ শিখরা বসবাস করেন। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু সংখ্যক শিখধর্ম ও সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী রয়েছে। শিখ ধর্মের রয়েছে ১০ জন প্রধান ধর্মগুরু যার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলেন গুরু নানক শাহী। তাদের পবিত্র ধর্ম 'গুরু গ্রন্থ সাহিব' রচনায় এ ধর্মের প্রথম পাঁচজন গুরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ও তাদের মাধ্যমেই সংকলিত হয়। পূর্বে থেকেই প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের জন্য রয়েছে প্রার্থনাস্থল বা উপাসনালয় যেখানে গিয়ে নিজ নিজ ধর্মের ধর্মানুসারীরা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। এক্ষেত্রে শিখ ধর্মও ব্যতিক্রম নয়। তাদেরও রয়েছে উপাসনালয় যাকে বলা হয় 'গুরুদুয়ারা'।
বাংলাদেশেও ইসলাম,হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরাদের মতো শিখ ধর্মের অনুসারীরা রয়েছে সেই সঙ্গে রয়েছে তাদে র প্রার্থনাস্থল 'গুরুদুয়ারা'। বাংলাদেশে শিখধর্মের প্রধান ও সবচেয়ে বড় গুরুদুয়ারাটি রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ও ডাকসু ভবনের সামনে, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের কোল ঘেঁষে, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত যাওয়ার রাস্তার ডানপাশে পাশে অবস্থিত।
প্রচলিত আছে যে, ১৬ শতকে শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক অল্প সময় এখানে অবস্থান করেছিলেন এবং তাঁর ধর্মের একেশ্বরবাদ ও ভাতৃত্বের কথা প্রচার করেন ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের রীতিনীতি শিক্ষা দেন। সেই স্মৃতি রক্ষার্থে বর্তমান গুরুদুয়ারাটি নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ভবনটির কিছু অংশ সংস্কার ও মেরামত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৮-৮৯ সালে ব্যাপক সংস্কার করা হয়। গুরুদুয়ারাটি অনেকবার সংস্কার ও মেরামতের ফলে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে মূল ভবনটির পাশে একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে অফিস কক্ষ, শিখ রিসার্চ সেন্টার ও অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়।
গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুইবার তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ ' গ্রন্থ সাহিব' পাঠ ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া প্রতি শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সাপ্তাহিক জমায়েত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। পুরোহিত 'গ্রন্থসাহিব' পাঠ ও কীর্তন করেন। কীর্তন ও প্রার্থনা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এখানে শুক্রবারে আগত অতিথিদের জন্য মধ্যাহ্নভোজেরও ব্যবস্থা থাকে। এছাড়াও উপাসনালয়টিতে বছরের বিভিন্ন সময় শিখধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হয়। গুরুদুয়ারায় আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গুরু নানকের জন্মবার্ষিকী, দশম গুরু গোবিন্দ সিং এর জন্মবার্ষিকী, খালসা সাজনা দিবস, নগর কীর্তন, লোহরী এবং পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি। এ অনুষ্ঠানগুলো এখানে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও উৎসবের আমেজে পালন করা হয়।
গুরুদুয়ারাটিতে প্রবেশে কারও জন্য কোনে বিধি-নিষেধ নেই। সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ -নির্বিশেষে সব বয়সী নারী ও পুরুষের দর্শনের জন্য প্রবেশাধিকার রয়েছে। প্রার্থনায় অংশগ্রহণ এবং প্রসাদ গ্রহণও করতে পারেন। ঢাকায় বসবাসরত শিখ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকজনের নিয়মিত এই গুরুদুয়ারাতে আসা যাওয়া রয়েছে । এছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের(মুসলিম, হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান) সব ধর্মের কিছু লোকজনকে শুক্রবার এই উপাসনালয়ে আসতে দেখা যায়। যা ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের এক অনন্য সুন্দর দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশেও শিখধর্ম নিয়ে বই লেখা ও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে শিখধর্ম নিয়ে রচিত 'শিখ ধর্মের উত্থান এবং তার ঐতিহাসিক পথচলা' শীর্ষক বইটি রচনা ও সম্পাদনা করেন লেখক,গবেষক,অনুবাদক, বহুভাষা ও ধর্মতত্ত্ববিদ মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। বইটিতে ভূমিকা ও শেষকথা ছাড়াও ষোলটি অধ্যায় রয়েছে। শিখধর্মের উত্থান,তার ক্রমবিকাশ,ভক্তি আন্দোলন থেকে শিখ আন্দোলন, শিখ ধর্মের বৃহত্তম ধারার দশ গুরুর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনা থেকে শুরু করে এ ধর্মের সকল বিষয়ে লেখক খুবই দক্ষতার সাথে খুঁটিনাটি সব তথ্য অতি প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন। যা শিখ ধর্ম সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে ও পড়তে আগ্রহীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করবে। এছাড়াও বইটির শেষে শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিবের কয়েকটি বাণীও রয়েছে।
লেখক: শিক্ষার্থী,হিন্দি ভাষা বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।