
প্রতীকী ছবি
সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের পরিশুদ্ধি অর্জন ও মহান প্রভুর সান্নিধ্য ও সন্তোষ অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আগমন করে সিয়াম সাধনার মাস রমজানুল মোবারক। সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিবৃত্ত থাকা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে নিবৃত্ত থাকার নাম সিয়াম। রমজানের পুরো মাস সিয়াম পালন করা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের একটি।
আখেরি নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন মদিনায় হিজরত করে যাওয়ার দ্বিতীয় বছরে রমজানের সিয়াম পালনের বিধান নিয়ে নাজিল হয় কুরআন মজিদের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতটি। ঘোষণা করা হয়, হে মুমিনরা, তোমাদের প্রতি সিয়াম পালন আবশ্যিক করা হলো, যেমন তা আবশ্যিক করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের প্রতি, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।
তিরমিজি শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর বরাতে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, রমজানের প্রথম রাত এলে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শিকলবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কোনো দরজা আর খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এরপর কোনো দরজা আর বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, হে কল্যাণপ্রার্থী, তুমি এগিয়ে এসো। আর হে অকল্যাণ প্রত্যাশী, তুমি নিবৃত্ত হও। আল্লাহ অনেককে মুক্তি দেবেন। প্রতিটি রাতে এভাবে ঘোষণা চলতে থাকে।
নেক কাজে উদ্যোগী হওয়া ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সব সময়ই জরুরি; কিন্তু এ মাসে তাতে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর অপার রহমত নাজিল হওয়ার মাসে নেক কাজ সম্পাদন এবং অন্যায় কাজ বর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ভাগ্যবানদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষ করে তাকওয়া অর্জনের যে উদ্দেশ্য সিয়াম পালনের মধ্যে নিহিত, তা সফল হতে হলে রমজানের প্রথম মুহূর্ত থেকেই সযত্নে চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া।
রমজান মুমিনের জীবন সাজানোর শ্রেষ্ঠ সময়। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু আত্মাকে নিষ্কলুষ করা। দীর্ঘ এগার মাসের পাপাচারের কারণে অন্তরে যে কালিমা লেপন হয়েছে তা দূর করতে হবে। কুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সামনের দিনগুলোতে প্রবৃত্তিসমূহ যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাপাচার ত্যাগ করার মনোবৃত্তিই পাপকার্য থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন. ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও পাপকার্য থেকে বিরত রইল না, তার রোজা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বুখারি শরীফ)
মাহে রমজান নিজেকে মুত্তাকি বানানোর মাস এবং নিজেকে অধিক ইবাদতের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন বানানোর মাস। রমজান মাসের ইবাদত অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক সওয়াবে পূর্ণ। রমজানে একটি নফল আদায় করলে অন্য মাসের একটি ফরজের সমান সাওয়াব পাওয়া যায়। আর একটি ফরজ আদায় করলে সত্তরটি ফরজের সমান সাওয়াব পাওয়া যায়। রমজান মাস রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতে পরিপূর্ণ। যার আত্মার সংশোধন যত বেশি হবে, সে তত বেশি রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত পাবেন।
রমজান মাস তাকওয়ার মাস। আর তাকওয়া সব ধরনের গুনাহকে বর্জন করে এক আল্লাহর ভয়কে অন্তরে স্থান দিয়ে জীবন পরিচালনার নাম। তাকওয়া অর্জনের দ্বারাই একজন মানুষের জীবনে পূর্ণতা লাভ করে। মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে তাকওয়া অর্জন করার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান করেছেন বারংবার। এ ব্যাপারে কুরআন মজিদের শুরুতেই আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হুদাল্লিল মুত্তাকিন’। অর্থাৎ এই পবিত্র কোরআন মুত্তাকি তথা তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য হেদায়াত স্বরূপ। আর প্রকৃত মুত্তাকি তারাই হতে পারে, যাদের আছে ‘ইসলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধি’। কারণ যার অন্তরের ইসলাহ বা আত্মশুদ্ধি আছে তার জন্য গুনাহমুক্ত জীবন ধারণ করা খুবই সহজ হয়ে যায়। আর আত্মশুদ্ধি ব্যতিরেকে কখনোই গুনাহ বর্জন করা সম্ভব নয়।
কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে এবং নিজের অন্তরকে কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে, জান্নাতই হবে তার জন্য চূড়ান্ত আবাসস্থল।’ (সূরা আন নাজিআত : ৪০)। তাই অন্তরকে পবিত্র রাখার জন্য নিয়মিত খাদ্য প্রদান ও পরিচর্যা অতিব প্রয়োজন। ঈমান ও নেক আমল হলো অন্তরের সেই খাদ্য। শরীর যেমন খাদ্য পেয়ে শক্তি অর্জন করে, তেমনি অন্তরও নেক আমলের মাধ্যমে শক্তি অর্জন করে। এই নেক আমলের সম্পর্ক শুধু মাহে রমজানের সাথেই নয় বরং এর সম্পর্ক সারা জীবনের সাথে।