
ভারতের অমৃতসারে পবিত্রতম স্থান হরিমন্দির শিব, যা স্বর্ণ মন্দির নামে বেশি পরিচিত
২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে মহা উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হলো শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের ৫৫০তম জন্মদিন। যদিও সারা পৃথিবীতে এই আধ্যাত্মিক ধারা একটি ধর্মের পরিসর গ্রহণ করেছে; কিন্তু আদিতে তা কি আদৌ কোনো ধর্মমত ছিল, নাকি এটি ছিল গুরু নানকের ঈশ্বর অন্বেষণের একটি বিশেষ মতাদর্শ?- এই বিষয়ে শিখ আন্দোলনের শুরু থেকে রয়ে গেছে বিতর্ক।
অনেকে মনে করেন আদি শিখধারা ইসলামী সুফীবাদ এবং ভারতীয় মরমি ও অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের একটি সমন্বিত ধারা, যার মূল স্রোত হচ্ছে ভারতের ১৫শ’ শতকের ভক্তি আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল কোনো সুনির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক কাঠামো থেকে আধ্যাত্মিকতা ও ঈশ্বর অন্বেষণকে বের করে আনা। এর কারণও সুস্পষ্ট, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বৈরিতা দূর করা এবং সেই সঙ্গে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বর্ণাশ্রম প্রথার ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্ত করা; কিন্তু নানকের মৃত্যুর পর বিশেষত তৃতীয় শিখগুরু অমরদাসের সময় এই আন্দোলন একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের রূপ পরিগ্রহ করল এবং কালে কালে তা ভারতের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণেও প্রবেশ করল। পঞ্চম গুরু অর্জুনের (পাঞ্জাবিতে অর্জন) অমৃতস্বরে হরিমন্দির সাহিব (যেটি অশিখদের কাছে স্বর্ণমন্দির নামে সমধিক খ্যাত) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিখ ধারা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অবয়ব লাভ করে। তিনি গুরু গ্রন্থসাহিত্যের প্রথম সংকলকও ছিলেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর পঞ্চম গুরুকে হত্যার পর শিখ ধর্ম সামরিক চরিত্র গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং শেষ মানুষ গুরু গোবিন্দ সিং খালসা আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই চরিত্রকে চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিক আদল দেন। এই প্রবন্ধে শিখ মতাদর্শ বা ধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আঙ্গিকগুলোকে নির্মোহভাবে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক কালপর্বে তার বিবর্তন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়াও শিখ ধর্মের আধ্যাত্মিক মর্মার্থ এবং তার রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যাকরণ বোঝাও এ প্রবন্ধে অন্যতম উদ্দেশ্য।
মহাপুরুষেরা মানবজাতির কল্যাণের জন্য ধর্ম-সম্প্রদায় সৃষ্টি করেন, তা থেকে আমরা সম্প্রদায়টাই নিই, ধর্মটা আর নিই না। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এক.
যে কোনো ধর্ম বা মতাদর্শের নির্মোহ পর্যালোচনার জন্য তার উত্থানের ঐতিহাসিক কালপর্ব এবং তার উৎপত্তিস্থলের বিচার জরুরি। স্বাভাবিকভাবেই আমরা শিখ ধর্মের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম করব না। প্রায় সর্বসম্মতভাবেই বলা চলে শিখ মতাদর্শের আদি প্রবর্তক আধ্যাত্মিক সাধক ও অতীন্দ্রিয়বাদী গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৯), যিনি সুলতানি আমলে ভারতের লাহোর প্রদেশের রাইভোই কি তালভান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যেটি এখন পাকিস্তানের পাঞ্জাবে অবস্থিত এবং বর্তমানে একে গুরু নানকের সম্মানে নানকানা সাহিব নামে ডাকা হয়। নানকের পিতার নাম ছিল কল্যাণ চাঁদ দাস বেদি, যিনি মেহতা কালু নামে বেশি পরিচিত ছিলেন এবং তার মাতার নাম ছিল তৃপ্তা; শিখরা তাকে মাতা তৃপ্তা নামে ডাকেন। বেদি পদবী থেকে বোঝা যায় নানকের পরিবার হিন্দু ক্ষত্রিয় গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা পাঞ্জাবের জাট গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন(১), যদিও তার পিতা পেশাগতভাবে ছিলেন স্থানীয় পাটোয়ারী বা হিসাব-রক্ষক। নানকের এক বোন ছিল, যার নাম ছিল নানকী। তিনি নানকের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন এবং তার বিয়ে হয়েছিল সুলতানপুর নিবাসী জয় রামের সঙ্গে, যিনি একটি গুদামের পাহারাদার ছিলেন। নানক তার বোনের সঙ্গে থাকতে শুরু করলে জয়রাম তাকেও একটি গুদাম-পাহারাদের চাকরি পেয়ে দেন। নানক সম্পর্কিত এসব তথ্য জানা যায়, শিখদের রচিত তার জন্ম-বৃত্তান্তসমূহে অর্থাৎ ‘জনম-সাখীগুলোতে’, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ‘গুরু নানক প্রকাশ’। এতে ৯ হাজার ৭০০টি পঙক্তি আছে। এর ধারাবাহিকতায় ‘সুরাজ প্রকাশ’ (সূর্যের আবির্ভাব) লিখিত হয়, যেটিকে ‘গুরু পরতাপ সুরাজ গ্রন্থ’’ও বলা হয়। সান্তোখ সিং (১৭৮৭-১৮৪৩) এটি রচনা করেন এবং আনুমানিক ১৮৪৩ সালে তা প্রকাশিত হয়(২)। প্রথম জনম-সাখীর রচনাকার গুরু নানকের আজীবন সঙ্গী ভাই বালা (১৪৬৬-১৫৪৪), যার প্রকৃত নাম ছিল তালভন্দি রাই ভাই। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি রচনা করেন। সমস্যা হলো ভাই বালার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে। কারণ শিখধর্মের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক ভাই গুরুদাস (১৫৫১-১৬৩৬) গুরু নানকের শিষ্যদের তালিকা করেছিলেন; কিন্তু সেই তালিকায় ভাই বালার নাম নেই(৩)। অন্য জনম সাখীগুলোতেও ভাই বালার কোনো হদিস নেই। অথচ শিখ সমাজে প্রথম জনম-সাখীটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়(৪)। অথচ শিখি উইকি (Sikhi Wiki) লিখেছে, ভাই বালা লিখিত জনম-সাখীর নাম ‘ভাই বালে ভালি জনমসাখী’- যিনি দ্বিতীয় গুরু অঙ্গদের সময় ১৫৯২ সালে এটি রচনা করেন।(৫) সান্তোখ সিং এটির অনুকরণে যে জনমসাখী রচনা করেন তাই আদতে গুরু নানক প্রকাশ। এরই ধারাবাহিকতায় (Sequel) দশম গুরু পর্যন্ত নিয়ে ‘সুরাজ প্রকাশ’ লেখা হয় এবং তা শেষ হয় ১৮৪৪ সালে(৬); কিন্তু সেখানে বলা হয়নি সুরাজ প্রকাশের রচনাকারও একই ব্যক্তি অর্থাৎ সান্তোখ সিং কি না। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যস্থিত ‘গুরুদুয়ারা নানকশাহীর’ এবং বাংলাবাজারস্থ ‘গুরুদুয়ারা সাঙ্গাতটোলা’র গ্রন্থি গুরবিন্দর সিং লেখককে জানিয়েছেন যে, সুরাজ প্রকাশ কোনো জনম-সাখী নয়। তিনি বলেন যে, কোনো শিখ ধর্ম সম্পর্কিত রচনায় গুরু নানক সম্পর্কিত বয়ানে তার জন্মবৃত্তান্ত থাকলেই তা জনম-সাখী হবে, এমন কোনো কথা নেই। মজার ব্যাপার হলো-গুরবিন্দর সিংয়ের পরবর্তীসময়ে যিনি গ্রন্থি হয়েছেন, সেই কমলজিৎ সিং আবার সুরাজ প্রকাশকে জনম-সাখী হিসাবে মান্যতা দিয়েছেন।
জনম-সাখীগুলো মূলত স্তুতিগ্রন্থ (hagiography) এবং এগুলোর বিরুদ্ধে শিখধর্মে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস-নির্ভর ও অলৌকিক কল্প-কাহিনিতে ভরপুর, যে কারণে জনম-সাখীগুলোর সব তথ্য গ্রহণে স্বভাবতই ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ পাঠকদের আপত্তি থাকতে পারে। তবে ধর্ম-অধিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিংবদন্তি ও অলৌকিক কাহিনির গুরুত্ব আছে, কারণ নানা আঙ্গিকে তার ভেতর অনেক সময় গভীর মর্মবাণী এবং সমাজে বসবাসকারী মানুষের অনুভূতি লুকিয়ে থাকে। শিখধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়।
দুই.
জনম-সাখীগুলোতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে নানকের ত্রিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর একটি ঘটনা ঘটে, যার মধ্য দিয়ে তার জীবন ভিন্ন পথে মোড় নেয়(৭)। কালি বেইন নদীতে (পাঞ্জাবি উচ্চারণে কালি বেঁই) এক সকালবেলা নানক গোসল করতে গেলে, তিনি আর ফেরত আসেননি। তার পরিবারের লোকজন ও বন্ধু-বান্ধব তাকে খুঁজতে গেলে তারা তার কাপড়-চোপড় নদীতীরে আবিষ্কার করে। সবাই বিশ্বাস করে যে, তিনি বোধহয় জলে ডুবে মারা গেছেন, যদিও ঘটনার তৃতীয় দিনে তিনি তাদের মাঝে আবার ফেরত আসেন। তিনি বলেন, তাদের মাঝে তার অনুপস্থিতকালে তিনি পরমসত্তা অর্থাৎ চূড়ান্ত সত্যের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। আর তার ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি যে কথাটি প্রথম বলেন, তা হলো, ‘কোনো হিন্দু নেই, কোনো মুসলমানও নেই’(৮)। এর মাধ্যমে তিনি বোঝালেন সম্প্রদায়ভিত্তিক চেতনায় ধর্মের অখণ্ড মানবতা খণ্ডিত হয় এবং চূড়ান্ত সত্য হয় আচ্ছাদিত। আদতে সব ধর্ম এক পরম সত্যের বার্তাই প্রচার করে(৯)। তাকে কোনো নামে বা ছাঁচে ফেললেই তার সার্বজনীনতা লোপ পায়। এভাবে তিনি নির্দিষ্ট ধর্মমতের বাইরে এসে চূড়ান্ত সত্য বোঝার আহ্বান জানালেন। বিষয়টি আরেকটু বিশদভাবে বলেছেন, ওয়েন কোল (Owen Cole)। নদীতে অদৃশ্য হওয়ার ওই ঘটনার পরে নানক ফিরে আসলে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো হিন্দু নেই, কোনো মুসলমানও নেই, তাহলে কার শিক্ষা আমি অনুসরণ করব? ঈশ্বর হিন্দুও না, মুসলমানও না, আর আমিতো অনুসরণ করি ঈশ্বরের পথ।”(১০)
স্পষ্টতই ভারতীয় মরমি সাধক কবিরের ছাপ তার মধ্যে ছিল, যেই কবির মুসলমান হলেও প্রচলিত ধর্মের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর অন্বেষণের বিরোধী ছিলেন। আর গুরু গ্রন্থসাহিবজুড়েও আছে কবিরের শিক্ষা ও বাণী। এই কবির বলেছিলেন- যদি ঈশ্বর মসজিদে থাকেন, তাহলে জগৎ কার কাছে থাকে?(১১)
এবং হরি পূর্বে থাকেন না, খোদাও পশ্চিমে থাকেন না। তাঁরা একজনই, যিনি থাকেন মানুষের হৃদয়ে।(১২)
নানকেরও আধ্যাত্মবাদের মর্মবাণী তার মাতৃভাষা পাঞ্জাবিতে ‘ইক ওয়ান কা সাত নাম’- অর্থাৎ পরম সত্তা একজনই, সত্য তার নাম ”।(১৩) এর অর্থ শিখধারা কঠিন একেশ্বরবাদী (monotheistic) ও অদ্বৈতবাদী (monistic), যার ঈশ্বরের নাম ‘আকাল পুরুষ’- অর্থাৎ তিনি সেই পুরুষ বা পরমেশ্বর, কাল যাঁর ওপর কোনো প্রভাব বিস্তুার করতে অক্ষম। স্থানিকতাও তাঁকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। তারপরেও তিনিই জগৎরূপে প্রকাশিত, ফলে এটি একটি সর্বেশ্বরবাদী ধর্মও (Pantheistic Religion) বটে; কিন্তু শিখ মতে, ঈশ্বরের ব্যাপ্তি জগতেরও আরও অধিক। ফলে এ বিচারে তা সর্বেশ্বরবাদকেও ছাপিয়ে যায়। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক, অতীন্দ্রিয় সাধক ও কবি ইবনুল আরাবির (১১৬৫-১২৪০) ‘ওয়াহাদাতুল ওজুদ তত্ত্বের’ মতোই নানকও মনে করতেন ‘আদতে ঈশ্বর ভিন্ন জগতে কিছুই নেই’। নানক বলেছেন- ভাই, আমার প্রভু একজনই, কেবল তিনিই বিরাজমান। (আদিগ্রন্থ: ৩৫০)(১৪)
এখানে একটি বিষয়ে নানকের সঙ্গে যিশু খ্রিস্টের মিল রয়েছে। যিশুও কোনো নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে পৃথিবীতে আসেননি। যিশু বলেছেন-
Do not think that I have come to abolish the Law or the Prophets; I have not come to abolish them but to fulfill them. (Matthew 5:17) (New International Version)
অর্থাৎ, মনে কর না যে, আমি আইন বা নবীদের বিনাশ করতে এসেছি; আমি তাদের বিনাশ করতে আসিনি বরং পূর্ণ করতে এসেছি। (মথী ৫:১৭)
তার মানে যিশুর সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে যে, নানক কোনো প্রচলিত ধারার ধর্মকে পূর্ণও করতে আসেননি। বরং তিনি কোনো প্রথা বা বর্গভিত্তিক ধর্মের বাইরে আসতে চেয়েছেন এবং সেখান থেকেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন।
ইসলামের মতোই নানকের ধারাতেও ঈশ্বরের কোনো লিঙ্গ নেই এবং এখানেও তিনি নিরাকার। তবে শিখ ধর্মের এক বড় অংশে বিষ্ণুর অবতাররূপে নানককে উপলব্ধির ব্যাপার আছে(১৫)। ফলে এ জায়গায় শিখ ধর্ম কালে কালে ভারতীয় ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মের একটি শাখা হিসেবে হাজির হয়েছে, তবে তা নানকের মৃত্যুর পরে। জীবিত নানকের বয়ানে হিন্দুয়ানী শব্দের সঙ্গে মুসলমানি শব্দও ছিল। নানক বলেছেন- মৃত্যু ঘটবে মানুষের আজরাইল ফেরেশতার হাতে(১৬)। এই আজরাইল মৃত্যুর ফেরেশতার ইসলামি নাম,(১৭) ইহুদি ধর্মেও তার নাম ওই একই। কারণ উভয়টিই সেমেটিক ধর্ম।
অনেক শিখ অবশ্য তাদের গুরুকে ঈশ্বর প্রেরিত দূত মনে করে এবং বলে যে, ঈশ্বর পূর্বেও তাঁর দূত প্রেরণ করেছেন, যেমন- ভারতীয় ঘরানা থেকে রামানন্দ, কবির, রবিদাস ইত্যাদি, আবার সেমিটিক ধারা থেকে মুহাম্মদ (সা.), যিশু, মূসা প্রমুখ। তাদের মতে, নানকও সেরকমই একজন। ফলে তারা গুরুদের ছবির সামনে আনত হয় না(১৮)। তারা বলে যে, গুরু নানক নিজেকে একজন ঈশ্বরের মুখপাত্র, সেবক ও দাসরূপে হাজির করেছিলেন। তিনি মানুষের জন্য একজন পথপ্রদর্শক ও শিক্ষক মাত্র(১৯)। এর প্রমাণ অবশ্য জপজী সাহিবে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হচ্ছে- সেই পরমসত্তার হুকুম পবিত্র, যা মানতে নানকও বাধ্য।
Nanak, it is written that you shall obey the Hukam of His Command, and walk in the Way of His Will.(২০)
শ্রী সুখমনী সাহিবে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, একমাত্র তিনিই মুক্ত, আর তিনি জগতকে মুক্তি দেন। -গুরু অর্জুন (শ্রী সুখমনী সাহিব, শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিব(২১))
লেখক এ সম্পর্কে গ্রন্থি গুরবিন্দার সিংকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান যে, শিখধর্ম যেহেতু প্রচলনবিরোধী (nonconformist) ধর্ম, ফলে গুরুকে ব্যক্তির ইচ্ছামতো বিবেচনা করার স্বাধীনতা এ ধর্মে আছে। সম্প্রতি পরিচিত হওয়া মূলত সিঙ্গাপুর নিবাসী এক শিখবন্ধু জাসপ্রীত সিং ঢাকাস্থ গুরুদুয়ারা নানক শাহীতে লেখককে জানান যে, তিনি এবং শিখদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিবই স্বয়ং ঈশ্বর, যে কারণে দশম গুরু গোবিন্দ সিং এই মহাগ্রন্থকে ষাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানিয়েছেন(২২)। তবে শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিব স্বয়ং ঈশ্বর - এই মতও শিখদের সর্বসম্মত মত নয়।
শিখধর্ম প্রতিমা পূজার ঘোরবিরোধী। এই ধারা অবশ্য মূলধারার ভক্তিবাদী গুরুদের প্রায় সবারই শিক্ষা। শিখ ধর্মে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পুরোহিত নেই; নারী-পুরুষ যে কেউ ভালোমত গুরু গ্রন্থসাহিব পড়তে পারলে এবং এতদা সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ জানলে গ্রন্থি হতে পারেন। এর কারণ কি ব্রাহ্মণ্যবাদের ভয়, যা ধর্মকে নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে কুক্ষিগত করতে চায়? অবশ্য ভারতবর্ষে প্রচলনবিরোধী সব ধর্মের প্রতিষ্ঠার পেছনে হয়তোবা ব্রাহ্মণ্যবাদের ভীতি কম- বেশি কাজ করেছে। সে যাই হোক, একজন গ্রন্থি মাত্রই গুরু গ্রন্থসাহিবের পরিচর্যা করবেন এবং সাধারণকে গুরুবাণী সম্পর্কে অবহিত করবেন, এই তার কাজ। প্রায়শ কোনো গ্রন্থি তার সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুদুয়ারার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও নিয়োজিত থাকেন।
তিন.
যদিও কোনো কোনো জায়গায় বলা হয়ে থাকে যে, শিখ ধর্ম সব ধর্মকেই গ্রহণ করে, সব ধর্মের ঈশ্বরকেই সে মান্যতা দেয়(২৩)। আমি এ কথার সঙ্গে একমত নই। শিখ ধর্ম সব ধর্মকে গ্রহণ করে তার মতো করে। শিখ ধর্মের ইসলাম বা হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত ব্যাখ্যা তার মতো করে ব্যাখ্যাকৃত। যদিও শিখ বিশ্বাস ইসলাম বা হিন্দুধর্মকে খাটো করার জন্য নয়।। উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক; শিখ ধর্মাবলম্বীরা মুহাম্মদকে (সা.) সম্মান করে এবং পয়গম্বর হিসাবেও মানেন। কিন্তু তারা তাকে শেষ পয়গম্বর হিসাবে মানেন না। এটাই তাদের বিভিন্ন গুরুর মত। যে কোনো গুরুর মত, ভাষ্য বা বাণীকে তাদের পাঞ্জাবি ভাষায় শিখরা ‘গুরুমত’ বা ‘গুরুবাণী’ বলে। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, মুহাম্মদ (সা.) এর পূর্বে ও পরে অনেক মুহাম্মদই এসেছেন।(২৪) এই চিন্তার একটা কারণ হতে পারে যে, তাকে শেষ পয়গম্বর মেনে নিলে তো নতুন কোনো ধর্ম বা আধ্যাত্মিক দর্শনের আবির্ভূত হওয়ার আর কোনো পথ থাকে না। গুরু নানকতো পয়গম্বর মুহাম্মদের (সা.) বহু পরে এসেছেন। তবে পয়গম্বর মুহাম্মদের (সা.) শেষ পয়গম্বরীত্ব নিয়ে শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিবে কোনো উচ্চ-বাচ্য হয়নি। এই বিষয়ে প্রধানত সরব হয়েছেন দশম গুরু গোবিন্দ সিং। তার ‘বচিত্তর নাটকে’ গোবিন্দ সিং পয়গম্বরকে (সা.) ওইসব দৈব পুরুষদের মাঝে রেখেছেন, যারা ঈশ্বরের নাম প্রকাশের বদলে নিজের নাম প্রকাশ ও প্রচারে বেশি সক্রিয় হয়েছেন। যেমন- গুরু গোবিন্দ সিং তার ‘বচিত্তর নাটকে’ লিখেছেন যে, ঈশ্বর তার সঙ্গে সংলাপ বিনিময়ের সময় বলেছেন, তিনি অনেক দৈব পুরুষ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন, যারা ঈশ্বরের নামগান করার পরিবর্তে নিজেদের ধ্যান-ধারণা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং কালে কালে লোকে তাদের উপাসনা করতে শুরু করেছে। পয়গম্বর মুহাম্মদ (সা.) এই তালিকায় আছেন।(২৫)
আরেক জায়গায় ওয়েন কোল (Owen Cole) দশম গুরুর সঙ্গে ঈশ্বরের কথপোকথনের অভিজ্ঞতা অনুবাদ করেছেন, যেখানে ঈশ্বর তাকে বলছেন,
I then created Muhammad, king of Arabia. He too established a religion of his own, cut off the foreskins of his followers, and made everyone repeat his name.(২৬)
বলা বাহুল্য যে, শিখরা খাতনা করে না।
যাই হোক, কোনো বিশ্বাসী মুসলমান পয়গম্বর (সা.) সম্পর্কে তার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হবেন না। আমার মনে হয়, পঞ্চম গুরু অর্জুনের যে মৃত্যু হয়েছিল মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাতে এবং নবম গুরু তেগবাহাদুরের (যিনি গোবিন্দ সিং এর পিতা) মোগল সম্রাট আরঙ্গজেবের হাতে, তাতে দশম গুরু ইসলামের সঙ্গে মোগল বাদশাহদের স্বেচ্ছাচারিতা গুলিয়ে ফেলেছেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেননি যে, ইসলাম ও রাজতন্ত্র এক জিনিস নয়। মুসলমান শাসকদের প্রতি তার ব্যক্তিগত ক্রোধ হয়তোবা পয়গম্বরকে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করতে তাকে প্ররোচিত করেছে। যে কারণে হয়তো এসব কথা তিনি শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিবে লিপিবদ্ধ করেননি। শেষ বিচারে এগুলো বিভেদের কারণ হতে পারে, এই উপলব্ধি হয়তো তার ছিল। আরও অনেক পরে ১৯০৪ সালে লিখিত তার এক অনুগামী সেবারাম সিং-এর এক বইতেও আমরা বক্তব্য পাই কিছুটা সমন্বয়বাদীর ঢংয়ে, He declared himself to be the last of the Prophets, which he apparently was amongst the Semitic saints and holy men, and the sole mediator between God and man for all time to come.(২৭)
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পয়গম্বর মুহাম্মদের (সা.) শেষ পয়গম্বর হওয়ার দাবিটি ঠিকই ছিল; কিন্তু সেটি সেমিটিক জাতিগোষ্ঠীসমূহের জন্য। অবশ্য সর্বকালে তার কর্মপরিধির জায়গাটা সেবারাম সিং স্বীকার করে নিয়েছেন।
অন্যদিকে দশম গুরু গোবিন্দ সিং বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও শিবকে এবং সেই সঙ্গে গোরক্ষনাথ ও রামানন্দকে একই কাতারে ঈশ্বরের দূত বানিয়ে ছেড়েছেন, যেটিও প্রচলিত ধারার কোনো হিন্দু মেনে নেবে না; কারণ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবতা, যাদের মাধ্যমে হিন্দু ত্রিত্ববাদ (the Hindu Trinity) গড়ে উঠেছে এবং এই তিনজন একাধারে সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও বিনাশকর্তা।(২৮) অন্যত্র রামচন্দ্রের সঙ্গে তার রক্ত-সম্পর্ক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গোবিন্দ সিং প্রথম যুগের শিখগুরুদের জাত-পাতবিরোধী যে শিক্ষা তা থেকে সাধারণ শিখদের হয়তো নিজের অজান্তেই কিছুটা বিচ্যুত করেছে। এখন যে অনেক শিখ জাত-পাতের বিচার করে, বিয়েও করে জাত-কূল দেখে, আর ওয়েন কোলও যার কঠোর সমালোচনা করেছেন, তার ভূত কি শিখদের কাঁধে দশম গুরু থেকেই সওয়ার হয়েছিল? - প্রশ্নটি ভাববার মতো।(২৯)
চার.
নানক ধর্মসমূহের মধ্যকার নানান রীতি-নীতি ও পদ্ধতিকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির মূল অনুষঙ্গ মনে করতেন না। বরং তিনি মনে করতেন, প্রকৃত মুসলমান বা হিন্দু হওয়া সহজ নয়। পুরোহিত ও মাওলানারা ধর্মকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থে। ফলে রীতি-নীতির ধুয়ো তুলে নয়, ঈশ্বরকে একান্ত মনে গভীরভাবে ডাকতে হবে।(৩০) তাই নানক প্রচলিত ধারার ধর্ম-বিশ্বাসের অনুগামী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন গভীর অতীন্দ্রিয় সাধক। তিনি মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, Hundreds of thousands of clever tricks, but not even one of them will go along with you in the end. – Guru Nanak(৩১)
বাংলা তর্জমায় যা দাঁড়ায়, ‘লক্ষ লক্ষ চতুর কৌশল রয়েছে, কিন্তু পরিশেষে একটিও তোমার সঙ্গে যাবে না’। - গুরু নানক (শ্রী জপজী সাহিব, শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিব, ১ম পৃষ্ঠা(৩২))
শিখধর্ম মূলত গুরুমুখী ধর্ম। গুরুরাই এখানে সব। এটি মিথ্যা নয় যে, সদগুরু হিসাবেই নানক ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে একটি মেলবন্ধন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নানক প্রচলিত ধর্মের আঙিনার বাইরে এসে ঈশ্বরকে নিজে হৃদয়ঙ্গম করতে ও অপরকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। তারপরেও শিখধর্ম কালে কালে একটি স্বতন্ত্র ধর্মের রূপ নিয়েছে।
নানক যখন ঈশ্বরের নামগান করে এবং মানুষসহ সব জীবের সেবার মাধ্যমে এবং মানুষের মধ্যে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভেদ তুলে এক ঈশ্বরের সেবকরূপে সবাইকে সমান করলেন, তখন তার অনুসারীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান পৃথক ছিল। নানক যখন গানের মধ্য দিয়ে বা কীর্তনের মাধ্যমে পরিব্রাজকরূপে তার ঈশ্বর বন্দনা শুরু করলেন, তার অন্যতম সঙ্গী ছিলেন মর্দানা নামের তার এক মুসলমান বন্ধু। ‘নাম সিমরান’ বা মানুষের আত্মিক পরিণতি ও সামগ্রিক সত্য বোঝার এবং পরম সত্যকে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করার যে সাংগীতিক ধ্যান নানক করতেন, সেখানেও তিনি সবাইকে নিয়েই ধ্যানমগ্ন হতেন। তার ঈশ্বরপোলব্ধি ইসলামের একেশ্বরবাদী চিন্তা ও হিন্দুধর্মের উপনিষদের খুবই সমান্তরাল, যা ‘মূলমন্তর’ নামে পরিচিত। এই ‘মূলমন্তর নানকের শিক্ষা ও ঈশ্বরোপাসনার সারাৎসার হিসেবে স্বীকৃত, যেটি পঞ্চম গুরু অর্জুন নিজে লিপিবদ্ধ করেন। এটি শুরু হয়েছে ‘ইক ওঙ্কার’ বা পরমেশ্বরের একত্বের ঘোষণা দিয়ে। গুরু গ্রন্থসাহিবের সূচনা বাণীটিও এই মূলমন্তর। এ বিষয়ে ইলিয়ানর নেসবিটের (Eleanor Nesbitt) প্রথম ইংরেজি অনুবাদটি প্রণিধানযোগ্য।
The is one God, truth by name, creator, fearless, without hate, of timeless form, beyond birth, self-existent, (known by) the grace of the Guru.(৩৩)
অর্থাৎ, ঈশ্বর একজন, সত্য তাঁর নাম, তিনি সৃষ্টিকর্তা, নির্ভয়, ঘৃণাহীন, কালাতীত, জন্মের ঊর্ধ্বে, স্বতঃ বিরাজমান, যাঁকে গুরুর কৃপা ব্যতীত জানা যায় না।
কোনো কোনো শিখ অবতারবাদে বিশেষত ঈশ্বরের মানবরূপ ধারণে বিশ্বাসী নন। যেমন- পাশুয়ারা সিং তার বইতে ঈশ্বরের জন্মগ্রহণের বিরোধিতা করেছেন। মূলমন্তরের অনুবাদ তিনি করেছেন নিম্নরূপে- There is one Supreme Being, the eternal reality, the creator, without fear and devoid of enmity, immortal, never incarnated, self-existent, known by grace through the true Guru.(৩৪)
নানক ছিলেন পরিব্রাজক, যে কথা আগে বলা হয়েছে। তিনি ছিলেন রামানন্দ, চৈতন্য, রবিদাস, কবির, শেখ ফরিদ, ভগৎপিপা প্রমুখ প্রচলিত ধারাবিরোধী (nonconformist) সাধকদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সময়কালও ছিল খুব কাছাকাছি। এটি সেই সময়কার কথা, যখন মুসলমান শাসকদের রণহুঙ্কার ও হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা ভারতীয়দের ইসলাম ও হিন্দুধর্মের প্রতি বিমুখ করে তুলেছিল। এর কারণ প্রকৃত ইসলাম ও তার মর্মবাণী ছিল সাধারণের কাছে অজ্ঞাত। ফলে সাধারণ মানুষ মুসলমান রাজা-বাদশাহদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যদিকে হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথায় বিষাক্ত বর্ণাশ্রম দেখেই ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম বিষয়ে অনুমান করত। নিম্নবর্ণের হিন্দুর ধর্মশিক্ষার অনুমতি ছিল না। মনুসংহিতা নিম্নবর্ণের হিন্দুর কাছে তার ধর্মকে ভীতিপ্রদ করে তুলেছিল। উপনিষদের অসাধারণ বাণীর চল তখনও সর্বত্র হয়নি। আর আমার অনুমান যে, পবিত্র কোরআন তখনো ভারতীয় সব ভাষাতে অনূদিত হয়নি। কোনো একটি দুটি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ হলেও, সেকালে মুদ্রণযন্ত্র ছিল না। তাই কোরআনের বিস্তৃতি বেশি দূর পর্যন্ত হয়নি। ফলে শুরু হলো হিন্দুদের ও মুসলমানদের একাংশের মধ্যে অপ্রচলিত ধারায় ঈশ্বর অন্বেষণ। জানা গেলো বনে-জঙ্গলে কিংবা হিমালয়ের গুহাতে নয়, এমনকি মসজিদ-মন্দিরেও নয়, ঈশ্বরের আবাস মানুষের হৃদয়ে। এই ধারা পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্র বাউল, বৈষ্ণব, সাধক, ফকিরের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। সুফিবাদে এই ধারা তাদের বিকাশের প্রথম জামানা থেকেই ছিল। কারণ এই চেতনা মূলত কোরআনাশ্রিত। সূরা কাফে আমরা পাই- অবশ্যই আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি, সেই সঙ্গে আমরা জানি তার নিভৃত আত্মা তাকে ফিসফিসিয়ে কি বলে, আর আমরা তার ঘাড়ের রগের চেয়েও নিকটে। (৫০:১৬)
এ দিক থেকে সুফি ও মরমিবাদিদের বিষয় বিবেচনা করলে নানকের শিক্ষার ধারা ভারতে নতুন কিছু নয়। আর শিখধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থসাহিবেও এই ধারার ঈশ্বরপূজারিদের গান ও বাণী লিপিবদ্ধ আছে। মনে রাখতে হবে, এটি ছিল ভক্তিবাদের যুগ। ফলে এই ধারার সবাই সহজভাবে নামজপ (শিখ বচনে নাম জাপো) ও আরাধনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর অন্বেষণের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, কারণ ধর্মের দুর্বোধ্য ব্যাখ্যা বিশেষত হিন্দু ধর্মের কঠিন শাস্ত্রীয় বিষয়াদি ধর্মকে সাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তাদের মাঝে অজনপ্রিয় করে তুলেছিল। ভক্তি-আন্দোলন ছিল ভারতে সহজিয়া মতাদর্শের মূল প্রবাহ। শেখ ফরিদ (১১৭৯-১২৬৬), নামদেব (১২৭০-১৩৫০), রামানন্দ (আনুমানিক ১৩০০-১৩৮০), কবির (১৩৯৮-১৪৪৮ বা ১৪৪০-১৫১৮), রবিদাস (১৪৫০-১৫২০), চৈতন্য (১৪৮৬- আনুমানিক ১৫৩৪), ভগৎপিপা (১৪২৫- আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ১৫ শতকের শুরুতে) প্রমুখ সবাই এই ভক্তি-আন্দোলনের পথিকৃৎ। শিখদের মধ্যেও তাই সবসময়ই গুরুর বাণী (শিখ বচনে গুরুবাণী)-যা ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তির প্রকাশক, সহজবোধ্যভাবে গানের মধ্য দিয়ে (শিখ বচনে শাবাদ কীর্তন) প্রচার করা ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। গুরু নানক ও অপরাপর শিখগুরু এবং নানকের পূর্বের বা সমসাময়িক ভক্তিবাদী গুরুদের পরেও দাদু দয়াল (১৫৪৪-১৬০৩), তুলসী দাস (১৫৩২-১৬২৩), নবোদাস (১৫৩৭-১৬৪৩) প্রমুখ আরও অনেক গুরুই ভক্তিবাদী আন্দোলনকে প্রবহমান রেখেছিলেন(৩৫)। এদের সবার চিন্তার স্মারক ঈশ্বরের একত্ব, যা হিন্দুদের মধ্যে এসেছে অদ্বৈতবাদের (ইংরেজিতে monism বলা চলে) হাত ধরে, যেটিও হয়তো মূল প্রেরণা ইসলাম থেকেই পেয়েছিল, পরে তার নানামুখী ব্যাখ্যা কালে কালে হাজির করা হয়েছে। আর সুফিবাদের ধারায় এবং মুসলমান অদ্বৈতবাদীদের মধ্যে এই একত্ববাদের প্রেরণা এসেছে কোরআনে বিবৃত ‘তাওহীদে’র হাত ধরে। পরে তাদের মধ্যে আদান-প্রদান ঘটেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এ ছাড়া এদের প্রায় সব ধারার মূল বিশ্বাসের অন্যতম যে, জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। তবে ঈশ্বর একই সঙ্গে স্বগুণ অর্থাৎ তিনি জগৎজুড়ে তাঁর সৃষ্টির মাঝে প্রকাশিত এবং একই সঙ্গে নির্গুণ অর্থাৎ নিরাকার- ভক্তিবাদীদের এই চিন্তার ধারাবাহিকতা বোধহয় ইসলামী দার্শনিকদের একাংশের ‘ওয়াহাদাতুল ওজুদ তত্ত্বের’ এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রীমদ্ভভগবৎ গীতার বয়ানাশ্রিত আকারেই হাজির হয়েছে। এ ছাড়া এরা প্রায় সবাই ছিলেন মানুষের বানানো বিগ্রহের পূজার বিরুদ্ধে।
পাঁচ.
সেকালের ভক্তিবাদের ধারা বুঝতে উদাহরণস্বরূপ রবিদাসের কথা বলা যায়। রবিদাস নানকের সমকালীন ছিলেন। গুরু গ্রন্থসাহিবেও তার অনেক ভজন বা স্তবগান লিপিবদ্ধ আছে। তিনি ছিলেন সমাজের অন্তঃজ ও অচ্ছ্যুত গোষ্ঠীর মানুষ, চর্মকার সম্প্রদায়ের লোক। নানকের মতো রবিদাসকে (পাঞ্জাবিতে ও সংস্কৃতে উচ্চারণ রাভিদাস) নিয়েও একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যাকে বলা হয় ‘রাভিদাসী ধর্ম’, ইংরেজিতে Ravidassia Religion। মজার ব্যাপার হলো, ইতিহাসে শিখদেরও একটি অংশ নিজেদের রাভিদাসী শিখ বলে প্রচার করেছে(৩৬)। তারা নানকসহ দশ গুরুকে গুরু মানতো, সেই সঙ্গে ভগৎ রবিদাসকেও। এরাও রবিদাসের মতো অন্তজ শ্রেণির লোক, তার মতো চর্মকার; কিন্তু সাধারণ শিখরা রবিদাসকে সম্মান করলেও তাকে তারা গুরু মানেনি। অনেক রবিদাসী যে কারণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এই ভেবে যে, শিখধর্মও জাতপাত বিচারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।(৩৭) রাভিদাসীরা প্রথম দিকে গুরু গ্রন্থসাহিবই মূলত পাঠ করত, যদিও পরে তারা শিখদের থেকে নিজেদের পৃথক করে নেয়(৩৮)। ২০১১ সালে ডেরা সাত খণ্ডে রবিদাসের বাণী ও শিক্ষা সংকলন করে তারা ‘অমৃতবাণী গুরু রবিদাস জী’ নামে প্রকাশ করে। যদিও তাদের অনেকে এখনো গুরু গ্রন্থসাহিবকেও মান্য করে। বর্তমানকালেও এই ধারার বা মতের বহু অনুগামী ভারতজুড়ে এবং ভারতের বাইরেও আছে এবং তাদের রবিদাসী গুরুদুয়ারাও আছে, যেখানে পালকিতে গুরু গ্রন্থসাহিবও বিদ্যমান থাকে(৩৯)। স্বভাবতই নানকের ধারার সঙ্গে তাদের মতাদর্শের বেশ সাদৃশ্যও আছে। যেমন তাদের বিশ্বাসগুলো:
১. ঈশ্বর এক, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বশক্তিমান,
২. মানবাত্মা পরমাত্মারই অংশ,
৩. ঈশ্বর জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনো মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন, এমনকি অন্তঃজ শ্রেণির মানুষের সঙ্গেও,
৪. ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য নিয়ত সব কর্ম বা অনুষ্ঠানেই তাঁকে স্মরণ করতে হবে,
৫. মনকে একমুখী রাখাই হচ্ছে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্মেলনের একমাত্র পন্থা।(৪০)
ধর্ম যে ঐতিহাসিক বাস্তবতার বাইরে নয়, তার প্রমাণ ওপরের তিন নম্বর ধারাটি। রবিদাস যেহেতু অচ্ছ্যুত গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন, তাই তার ধর্ম-সংস্কারকে তিনি তার বর্ণ এবং বর্গের অনুকূলে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। নানক যেহেতু নিম্নবর্ণের মানুষ ছিলেন না, তাই বিশ্বাসের ধারা আকারে ‘অন্তঃজ শ্রেণি’ এই নাম উল্লেখ করে তাকে বলতে হয়নি। অবশ্য নানক জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধী ছিলেন। নানক বলেছেন, জাতি-পরিচয় মূল্যহীন এবং অপ্রয়োজনীয় নামে মহিমা আরোপণ; সমগ্র মানবতার আশ্রয়স্থল একটিই। (আদিগ্রন্থ : ৮৩)(৪১)
নানক আরও বলেছেন, মৃত্যুর পরেতো কোনো জাতি নেই। (আদিগ্রন্থ : ৩৪৯)(৪২)
আবার তৃতীয় গুরু অমরদাসও বলেছেন, মৃত্যুর সময়তো তুমি তোমার জাতি সঙ্গে নিয়ে যাবে না, তোমার কাজই তোমার নিয়তি নির্ধারণ করবে। (আদিগ্রন্থ : ৩৬৩)(৪৩)
আর পঞ্চম গুরু অর্জুন আধ্যাত্মিক সাধনায় অচ্ছ্যুৎ সমেত সবার অধিকার নিশ্চিত করলেন, আধ্যাত্মিক শিক্ষা সবার জন্য- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। (আদিগ্রন্থ : ৭৪৭)(৪৪)
দুঃখজনকভাবে এর পরেও অনেক শিখ এখনো জাতিভেদ প্রথা মেনে চলে, যার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে।
রবিদাসের অনুসারীরাও তাদের গুরুকে অবতার জ্ঞান করে। রবিদাসের বাণী ভক্তিবাদের জায়গায় নানকের খুবই কাছাকাছি, সেই একইভাবে সহজ কথায় ঈশ্বরকে বোঝা ও তার জপ করার ধারা। তার এই শ্লোকটি পড়লে তা সহজেই অনুমেয়,
If I did not commit any sins, O Infinite Lord,
How would you have acquired the name, Redeemer of Sinners?(৪৫)
আমি যদি কোনো পাপ না করি, ও অনন্ত প্রভু,
তবে কীভাবে তুমি পতিত-পবন নাম ধারণ করলে?
ভারতের সর্বত্র এই ভক্তি-আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। বাংলাতেও পঞ্চদশ শতকে এই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। তার সবচেয়ে সার্থক রূপকার ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬-১৫৩৪)। শ্রী চৈতন্যের পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র। সংকীর্তণ ও নগরকীর্তণের মাধ্যমে ভক্তিভরে কৃষ্ণকে ডাকলেই তাকে পাওয়া সম্ভব, এই ছিল চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন- যা এক সহজিয়া ধারাও বটে। লক্ষ্যণীয় যে, শিখদের শাবাদ কীর্তন ও চৈতন্যের সংকীর্তণের লক্ষ্য একই- সহজভাবে ঈশ্বরকে ডাকা ও তাঁকে অনুভব করা। শ্রী চৈতন্য বলেছিলেন, ‘মুচি হয়েও সূচি হয়, যদি কৃষ্ণ ভজে।’
বোঝাই যাচ্ছে যে, চৈতন্য দেব ভক্তিবাদকেই আশ্রয় করেছিলেন, যদিও গুরু গ্রন্থসাহিবে চৈতন্যের বা তার কোনো ভক্তের কোনো বাণী বা স্তবগান স্থান পায়নি। এর একটি কারণ সম্ভবত চৈতন্য প্রতিমার আরাধনা করেছেন। রাধা-কৃষ্ণের যুগল আরাধনাকারীকে যে কারণে ভক্তিবাদীদের মূল প্রবাহ নিজেদের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে চায়নি; কিন্তু সে যাই হোক, সেই আমলে ভক্তিবাদের জোয়ার পুরো ভারতবর্ষকে প্লাবিত করেছিল। ফলে বঙ্গদেশেও যে তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এর প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী, তা বোঝা যায় যখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) মধ্যেও ভক্তিবাদের আভাস পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,
‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় মন্দির, কাবা আর কিছু নাই।’
ছয়.
শিখ ধর্মের আরও কিছু বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা যাক, যা শিখ ধর্ম বোঝার জন্য জরুরি। যেমন : শিখধর্মে শুধু ‘নাম সিমরান’ বা গুরু গ্রন্থসাহিব থেকে নেওয়া স্তবগানগুলো পরিবেশন করলে হবে না, নিজেকে অন্যের সেবায় বিলিয়ে দিতে হবে। আর ‘অহম’কেও বলি দিতে হবে। শিখ শাস্ত্রে সেবা তিন রকমের, যথা : তান (দৈহিক), মান (মানসিক) ও ধান (বস্তুগত)। এ ছাড়া শিখধর্ম সৎ পেশা বা কাজের (কিরাত কারনি) মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়,(৪৬) প্রয়োজনে সম্পদ ও অন্যান্য দ্রব্য সমাজের অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করাও (ভান্দ চাকনা) গুরু নানকসহ সবগুরুর শিক্ষা ছিল, আর ঈশ্বরের নাম স্মরণতো (নাম জাপনা) আছে- এই নিয়ে শিখধর্মের তিন স্তম্ভ(৪৭)। লঙ্গর বা সর্বসাধারণের পাকঘরে সবাইকে খাবার সেবাদান ‘ভান্দচাকনা’রই অনুষঙ্গ।
১৪৯৯ সাল থেকে নারী-পুরুষের সবরকম সমতা শিখ সমাজে গৃহীত হয়েছে। তখন থেকে একজন নারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মীয় পৌরহিত্যসহ সবকাজে পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করবে, এই বিধান চালু হয়েছে।(৪৮)
শিখ ধর্মের আরেকটি অন্যতম স্তম্ভ ‘ন্যায়-বিচার’। পাশাওরা সিং ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে দশম গুরু গোবিন্দ সিং থেকে এইভাবে উদ্ধৃত করেছেন,
One must first try all the peaceful means of negotiation in the pursuit of justice and if these fail then it is legitimate to draw the sword in defense of righteousness.(৪৯)
শিখধর্মে কোনো সন্যাসপ্রথা নেই, এটি গৃহীর ধর্ম। গৃহে অবস্থান করেও ব্যক্তির বৈরাগ্য থাকবে পৃথিবী-আসক্তির প্রতি, এই হলো শিখ ধারার শিক্ষা।
সাত.
শিখধর্মের বৃহত্তম অংশ দশজন মানুষ গুরুতে বিশ্বাস করে। আমরা তাদের নাম ও সময়কাল (জন্ম-মৃত্যু) নিচে উদ্ধৃত করছি,
১. গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৯) ৬. গুরু হরগোবিন্দ (১৫৯৫-১৬৪৪)
২. গুরু অঙ্গদ (১৫০৪-১৫৫২) ৭. গুরু হররায় (১৬৩০-১৬৬১)
৩. গুরু অমর দাস (১৪৭৯-১৫৭৪) ৮. গুরু হরকিষাণ (১৬৫৬-১৬৬৪)
৪. গুরু রামদাস (১৫৩৪-১৫৮১) ৯. গুরু তেগবাহাদুর (১৬২১-১৬৭৫)
৫. গুরু অর্জুন (১৫৬৩-১৫৮১) ১০. গুরু গোবিন্দ সিং (১৬৬৬-১৭০৮)
ছয়জন শিখ গুরুর বাণী গুরু গ্রন্থসাহিবে সংকলিত আছে, যথা : গুরু নানক (৯৭৪টি স্তবগান বা যুসহ), গুরু অঙ্গদ (৬২টি দ্বিতীয় বা couplet), গুরু অমরদাস (৯০৭টি স্তবগান), গুরু রামদাস (৬৩৮টি স্তবগান), গুরু অর্জুন (২২১৮টি স্তবগান) ও গুরু তেগবাহাদুর (৫৯টি স্তবগান ও ৫৬টি দ্বিতীয়)(৫০)। এতে ১৮টি ভাষার শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে গুরবিন্দর সিং লেখককে জানিয়েছেন। দশম গুরু গোবিন্দ সিং নিজে এই সংকলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করার পরেও তিনি তার নিজের কোনো দ্বিতীয় বা স্তবগান তাতে সংকলন করেননি(৫১)। ছয়জন শিখ গুরুর ‘গুরুবাণী’ সংকলিত করে তিনি নিজেই তার সামনে আভূমি প্রণত হন এবং ঘোষণা করেন তার পরে আর কোনো মানুষ গুরু নেই। এখন থেকে গুরু গ্রন্থসাহিবই শুধু গুরু। গুরু গ্রন্থসাহিবে আর যাদের লেখা আশ্রয় পেয়েছে, তারা হলেন :
কবির-২৯২টি স্তবগান, ২৪৩টি দ্বিতীয় ধন্য : ৪টি স্তবগান
শেখ ফরিদ- ৪টি স্তবগান, ১৩০টি দ্বিতীয় পিপা- ১টি স্তবগান
নামদেব- ৬০টি স্তবগান সাইন- ১টি স্তবগান
রবিদাস- ৪১টি স্তবগান ভিখান- ২টি স্তবগান
জয়দেব- ২টি স্তবগান সুরদাস- ২টি স্তবগান
বেনী- ৩টি স্তবগান সুন্দর- ১টি স্তবগান
ত্রিলোচন - ৪টি স্তবগান মর্দানা- ৩টি দ্বিতীয়
পরমানন্দ- ১টি স্তবগান সত্য ও বলবন্দ- ১টি স্তবগান
সাধনা- ১টি স্তবগান ভাট কবিগণ- ১১৩টি চতুষ্পদী শ্লোক(৫২)
রামানন্দ- ১টি স্তবগান
আট.
একদা বৈষ্ণবশাস্ত্রের গভীর অনুরাগী ও বিষ্ণুর পরম ভক্ত অমরদাস তার ভাগ্নের স্ত্রী আমরোর মুখে গুরু নানকের একটি স্তবগান শুনে গভীরভাবে আন্দোলিত হন। এই আমরো ছিলেন প্রধান শিখধারার দ্বিতীয় শিখগুরু অঙ্গদের কন্যা। ষাট বছর বয়সে তিনি অঙ্গদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শিখ হিসাবে দীক্ষা নেন। ১৫৫২ খ্রিষ্টাব্দে অঙ্গদের মৃত্যুর আগে তিনি অমরদাসকে গুরু হিসাবে অভিষিক্ত করেন। অমরদাস দীর্ঘ ৯৫ বছর বেঁচেছিলেন এবং এর মধ্যে তিনি শিখদর্শনকে একটি পরিণত ধর্মীয় কাঠামো দান করেন। শিখধর্ম বিশারদ ও প্রচারক তৈরির কাজে তিনি ‘মানজি’ প্রথা প্রবর্তন করেন। তিনি পুঁথিতে স্তবগান সংকলন করা শুরু করেন, যা পরবর্তীসময়ে গুরু গ্রন্থসাহিবের জন্য সংকলনের কাজকে সহজ করেছে। গুরু নানক ও গুরু অর্জুনের (পাঞ্জাবিতে অর্জন) পরেই তার সবচেয়ে বেশি স্তবগান গুরু গ্রন্থসাহিবে লিপিবদ্ধ আছে। তার রচিত স্তবগানগুলোকে একত্রে ‘আনন্দ সাহিব’ বলা হয়। তিনি অনেক প্রথা ও পর্ব শিখ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করেন; যেমন: আনন্দ কারাজ, দিওয়ালি, মাঘী, বৈশাখী প্রমুখ। তিনি শিখ তীর্থযাত্রারও প্রচলন করেন। শিখ তীর্থযাত্রীদের জন্য গোয়িন্দভালে তিনি ৮৪ ধাপ সম্বলিত জলাশয় নির্মাণ করেন, যার নাম হচ্ছে বাউলি; সেই সঙ্গে শিখ তীর্থযাত্রীদের জন্য তিনি ধর্মশালাও নির্মাণ করেন। শিখধর্ম প্রচার ও প্রসারে আয়ের দশভাগের এক ভাগ দান বা ‘দাসভান্ত’ প্রথাও তার দ্বারা প্রবর্তিত হয়। অমৃতস্বরে হরিমন্দির সাহিব (যার আক্ষরিক অর্থ ঈশ্বরের মন্দির বা ঘর(৫৩)) বা স্বর্ণমন্দির প্রতিষ্ঠার জায়গাটিও তার নির্বাচিত। মোগল সম্রাট আকবরের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল বলে জনমসাখীতে উল্লেখ আছে। সেখানে আছে যে, হরিদারের হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর থেকে কর তুলে নিতে তিনি আকবরকে রাজী করেছিলেন। অবশ্য স্বর্ণমন্দির প্রতিষ্ঠার কাজটি করেন পঞ্চম গুরু অর্জুন, যেটির ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেন বিখ্যাত মুসলিম সুফী ও কাদেরীয়া ঘরানার প্রখ্যাত সাধক হযরত মিয়া মীরকে (র.) দিয়ে করিয়েছিলেন বলে কিংবদন্তি চালু আছে।(৫৪)
নয়.
ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে শিখ মতাদর্শ বা শিখধর্ম বেশ কয়েকটি ধারায় (denominations) বিভক্ত হয়েছে। এই বিভাজন কেন হয়েছে তা জানা শিখ ধর্মের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার জন্য জরুরি।
ক) শিখধর্মের প্রথম বিভাজনের নায়ক গুরুনানক এবং তার স্ত্রী মাতা সুলাখনীর (৫৫) জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী চাঁদ (১৪৯৪-১৬৪৩ বা ১৬২৯), যিনি বাবা শ্রী চাঁদ নামেও সমধিক খ্যাত। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী শ্রী চাঁদ যোগবিদ্যায় ব্যাপক পারদর্শী বা যোগসিদ্ধ পুরুষ ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি তার বাবার প্রতিও খুব নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি ছিলেন কৌপীনধারী সন্যাসী। তার বাবার নানকানা সাহিব ত্যাগের পরেও তিনি ডেরাবাবা নানকে থেকে যান ও ‘গুরুনানক দেবজী মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন।(৫৬) তিনি ‘উদাসী’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা, যাদের কাজ হচ্ছে পরিব্রাজক প্রচারক (itinerary preacher) হিসাবে নানকের শিক্ষা ও দেশনা প্রচার করা। উদাসীদের ‘কারিকা’(৫৭) বা ধর্মীয় পুস্তক ‘মাত্রাসাহিবে’ তার স্তবগানগুলো সংকলিত আছে(৫৮)। তার সঙ্গে গুরু নানকের সম্পর্ক কখনো খারাপ ছিল- এরকম কোনো ইতিহাস জানা যায় না। অন্যান্য শিখ গুরুরাও যে তাকে বিশেষ সম্মান করতেন তার ইতিহাসও পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন যে, তৃতীয় গুরু অমরদাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘বাবা মোহন’ তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। (৫৯) চতুর্থ গুরু রামদাস তার দর্শন নিতে এসে তার চরণও স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। (৬০) এই শ্রী চাঁদ কেন ভিন্ন পথে এগোলেন? বিষয়টি আজও রহস্যাবৃত। এর কারণ কি এই যে, নানক বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পরে শিখ আন্দোলন একটি আনুষ্ঠানিক ধর্মের রূপ নেবে, যা নানকের অভিষ্ট লক্ষ্য ছিল না। বরং তিনি এর বিপরীত স্রোতেই চিরকাল ছিলেন। যে কারণে তিনি পুত্রকে আলাদা রাখতে চেয়েছেন। নানক ৩০ বছর বয়সে দৈবজ্ঞান লাভ করেন। এমনও হতে পারে যে, অল্প বয়সে বিয়ে না করলে নানক দৈবজ্ঞান লাভ করার পর শ্রী চাঁদের মতোই সন্যাস নিতেন ও অবিবাহিত থাকতেন? নানক ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলে তাকে পাঞ্জাবের কারতারপুরে সমাহিত করা হয়, যা এখন পাকিস্তুানে পড়েছে। ৫৫ বছর বয়স থেকে নানক এখানেই স্থায়ী হয়েছিলেন; কিন্তু বড় পুত্রের প্রতি তার কোনো অনুযোগ ছিল এমন কথা বিশ্বস্তসূত্রে শোনা যায় না। নানকের সমাধি মন্দিরটিকে ‘গুরুদুয়ারা দরবারসাহিব কারতারপুর’নামে ডাকা হয়। নানকের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি হন ভাই লেনা, যাকে ‘অঙ্গদ’ অর্থাৎ আমার শরীরের অঙ্গ এই নামে গুরু নানক তাকে অভিহিত করেছিলেন বলে শিখদের বৃহত্তম অংশের অভিমত। তিনিও কখনো শ্রী চাঁদের প্রতি বিষোদ্গার করেছিলেন এমন শোনা যায়নি।
খ) এর পরবর্তী বিভাজনটি শিখদের মধ্যে হয়েছে চতুর্থ গুরু রামদাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র পৃথ্বী চাঁদের (১৫৫৮-১৬১৮) নেতৃত্বে। তার প্রতিষ্ঠিত মতকে বলা হয় ‘মিনাস’। মিনাস শব্দটি এসেছে পাঞ্জাবি শব্দ মিনা থেকে, যার অর্থ প্রতারক, প্রবঞ্চক, ভন্ড, ইতর ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে নামটি পৃথ্বী চাঁদের নিজের বা তার অনুসারী কারো দেওয়া নয়, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই এই নামটি তাদের ওপর আরোপ করেছে। ইতিহাসটি এরকম যে, চতুর্থ গুরু রামদাসের তিন পুত্র ছিল; যথা: পৃথ্বী চাঁদ, মহাদেব ও অর্জুন। শিখি উইকি আমাদের জানাচ্ছে যে, পৃথ্বী চাঁদ ছিলেন পিতার অবাধ্য ও উদ্ধত সন্তান। তিনি পিতার শিক্ষা ও আদেশ মানতেন না। তার পরবর্তী ভাই মহাদেব (পাঞ্জাবিতে মহাদেভ) ছিলেন অতি ধার্মিক। অন্যদিকে ছোট পুত্র অর্জুন পিতার সব শিক্ষা ও আদেশ-নিষেধ ঠিকমতো মেনে চলতেন।(৬১) ফলে পিতা তাকেই পরবর্তী গুরু হিসাবে অভিষিক্ত করেন; কিন্তু পৃথ্বী চাঁদকে গুরু হিসাবে মেনে আরেকটি শিখধারা প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে পৃথ্বী চাঁদের পুত্র মনোহর দাস, যিনি ‘মেহেরবান’ (পাঞ্জাবিতে মিহারবান) নামে অধিক পরিচিত, অভিষিক্ত হন এই ধারার পরবর্তী গুরু হিসাবে(৬২)। তাই এই ধারার অনুসারীরা নিজেরা ‘মিহারবানস’ বা মিহারবান সম্প্রদায়’ নামে অভিহিত হতে পছন্দ করেন। জনমসাখীতে মেহেরবান (১৫৮১-১৬৪০) অবশ্য তার পিতার গৌরব বর্ণনা করেছেন। বিশেষত ভাই বালা বর্ণিত জনমসাখীতে এই ইতিহাস জানা যা(৬৩)। মুশকিল হচ্ছে, আমরা আগে ভাই বালার ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছি। উইকিপিডিয়া বলছে যে, পৃথ্বী চাঁদ গুরু অর্জুনকে হত্যার জন্য মোঘলদের সাহায্য করেন, এমনকি নেতৃত্ব দখলের জন্য তিনি অর্জুনের শিশুপুত্র হরগোবিন্দকেও বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেন।(৬৪) গোবিন্দ সিং পৃথ্বী চাঁদ প্রবর্তিত ধর্মদর্শনকে পাঁচ অনৈতিক দল বা ‘পান্জ মেলের’ একটি বলে অভিহিত করেন। শিখ এনসাইক্লোপেডিয়া জানাচ্ছে যে, মেহেরবান পৃথ্বী চাঁদের পুত্র হলেও শৈশবকালে দীর্ঘ সময় তিনি তার কাকা অর্জুনের সঙ্গে কাটিয়েছেন এবং তার কারণে তিনি হয়ে উঠেন বিদ্বান ও সাহিত্যানুরাগী। তিনি তার পিতার সঙ্গে অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হননি এবং বহু গুপ্ত সাধন বিদ্যা (sacred lore) ও ধর্মীয় শ্লোক রচনা করেন। তিনি দীর্ঘকাল ধর্মপ্রচারে ব্যয় করেন।(৬৫) মিহারবান-মিনা শিখরা ১৭ শতকে অমৃতস্বর ও হরিমন্দির সাহিব (যেটিকে শিখরা পাঞ্জাবিতে ‘শ্রী হারমান্দির সাহিব জী’(৬৬) বা ‘শ্রী হারমান্দার সাহিব জী’(৬৭) এবং ‘শ্রী দরবার সাহিব জী’ নামেও ডেকে থাকেন) নিয়ন্ত্রণ করত গুরু অর্জুনের নেতৃত্বে(৬৮)। ফলে এই দলের সবার প্রতি গোবিন্দ সিং-এর বিষোদ্গার তর্কাতীত বা সন্দেহাতীত নয়।
গ) তৃতীয় বিভাজনটি হয় সপ্তম গুরু হর রায়ের (কোনো কোনো শিখ উচ্চারণ করেন হরিরায়(৬৯)) জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম রায়ের (১৬৪৬-৮৭) কারণে। এই বিভাজনটির কারণ একাধারে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক। জানা যায়, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তার বৈমাত্রেয় ভাই দারাশিকোর প্রতি গুরু হর রায়ের সমর্থন ছিল; অন্তত কেউ কেউ সম্রাটকে তার বিরুদ্ধে এই তথ্য দিয়ে তাকে তার বিরুদ্ধে তাতিয়ে তোলে। সম্রাট গুরুকে দরবারে ডেকে পাঠালে তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম রায়কে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন। দরবারে আলেমগণের প্ররোচনায় সম্রাট যখন গুরু নানকের বাণীর সংকলন ‘আসা দি ভার’-এর কোনো এক ছত্রে মুসলমানদের অপমান করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন, তখন তিনি সংকলক ভুল সংকলন করেছেন বলে তাদের মন রক্ষা করেন। কোনো কোনো সূত্রে জানা যায়, তিনি তখন কিছু চরণ পরিবর্তন করেন। এতে সম্রাট তাকে দেরাদুনে জায়গীর দান করেন; কিন্তু পিতা তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বাড়ি ফিরতে মানা করেন(৭০)। কিছু সংখ্যক শিখ তার সঙ্গে থেকে যান। এরাই রামরাইয়াস বা রামরাইয়া সম্পদ্রায় নামে অভিহিত হন। দশম গুরু এদেরও পাঁচ অনৈতিক দল বা ‘পান্জ মেলের’ একটি বলে অভিহিত করেন।(৭১) এছাড়া আরও জানা যায় যে, রাম রায় সম্রাটকে খুশি করতে অলৌকিক কর্ম করে দেখান। লোকজনকে খুশি করতে অলৌকিক কর্মকাণ্ড করা শিখধর্মে নিষিদ্ধ, যে কারণেও তার পিতা তার উপর ক্রুদ্ধ হন।(৭২) কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায় থেকে যায়। যদি ধরা যায়, অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক বলতে কিছু আছে, তবে প্রশ্ন জাগে, অলৌকিক কর্ম লোকজনকে খুশি করতে দেখানো কীভাবে সম্ভব, যদি তা সর্বোতভাবে ঈশ্বরের এখতিয়ারে? অলৌকিক কর্ম তো যাদুটোনা না, আর ঐশ্বরিক ক্ষমতা তো ব্যক্তি নিজের খেয়াল-খুশি মতো ব্যবহার করতে সক্ষম নয়। অন্য দিকে তিনি যদি নিজেই ঈশ্বর হন, তবে তার কাজের মূল্যায়ন মানুষ করার কে? হয়তো তার কাজ ঠিক ছিল, সাধারণ মানুষ তা বুঝতে অক্ষম। এই বিষয়টি কেনো শিখদের চিন্তায় এলো না? হয়তো কিছু লোকের মনে হয়েছিল। যে কারণে হয়তোবা কিছুসংখ্যক লোক রাম রায়কে গুরু মেনে নিয়েছিল; কিন্তু রাম রায়কে গুরু না করাতে গুরু হর রায়কে তার পাঁচ বছর বয়সী পুত্র হর কিষাণকে গুরু করতে হয়েছিল; যিনি ইতিহাসে ‘বাল গুরু’ ও ‘হরি কিষাণ সাহিব’ নামে অভিহিত হয়ে আছেন। তিনি মাত্র সাড়ে সাত বছর বয়সে গুটিবসন্তে মারা যান।(৭৩)
ঘ) চতুর্থ বিভাজনটি যারা করে, তারা ‘নানকপন্থী’ নামে পরিচিত। তবে এই নাম নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। শিখি উইকি জানাচ্ছে যে, চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে যে ভক্তি আন্দোলন চলছিল, যেটি ছিল ভারতের ইতিহাসে সহজিয়া ধারা বা সহজিয়া আন্দোলনের বৃহত্তম প্রবাহ এবং তাদের মতামতগুলোর মধ্যে প্রবল সাদৃশ্যও ছিল, যার কারণ আমরা পূর্বে ব্যাখ্যা করেছি; সেখানে এই ধারার যে কোনো পবিত্র পুরুষের অনুসারীদের আলাদা করা হতো ওই ব্যক্তির নামের সঙ্গে পন্থী জুড়ে দিয়ে; যেমন: কবিরপন্থী, দাদুপন্থী ইত্যাদি। এই ধারাবাহিকতায় নানকপন্থী বললে সে যুগের সব শিখকেই বোঝানো হয় এবং একই সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও, যারা ভক্তি আন্দোলনের সব ভগৎ বা সন্তদের মধ্যে নানককে একজন মনে করতেন এবং তাকে বিশেষ সম্মান দিতেন।(৭৪) আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, এই ভক্তিবাদী ধারার কেউ কোনো ধর্ম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মাঠে নামেননি। ফলে পরবর্তী সময়ে বিশেষত দশম গুরুর সময় যেসব নিয়ম-কানুন বেঁধে দেওয়া হয়, অত্যাবশ্যকীয় মনে করে নানকপন্থীরা তা গ্রহণ করেননি; যেমন গোবিন্দ সিং প্রবর্তিত পান্জ কাকার বা পান্জ কাক্কে ধারণ করা: কেশ, কারা, কাঙ্গা, কিরপান ও কাছা;(৭৫) অর্থাৎ পাগড়ির নিচে বড় চুল রাখতে হবে, হাতে কয়ড়া পরতে হবে, মাথায় ছোট চিরুনি রাখতে হবে, তলোয়ার ধারণ করতে হবে এবং নিচে কাছা মারতে হবে। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের বেশীর ভাগ হিন্দু নিজেদের নানকপন্থী বলে পরিচয় দেয়।
ঙ) পঞ্চম বিভাজনটি এসেছে গুরু গোবিন্দ সিং-এর খালসা আন্দোলন থেকে। এরাই পান্জ কাকার বা পান্জ কাক্কে ধারণকারী। এদের মধ্যেও যারা সবচেয়ে নিষ্ঠাবান এবং নিরামিশাষী ও ধর্মীয় বিধিবিধান কঠোরভাবে মান্যকারী, তাদের বলা হয় অমৃতধারী। মূলত নবম গুরু তেগ বাহাদুরকে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব হত্যা করলে পান্জ কাকার প্রথা সামরিক প্রথা হিসাবে দশম গুরু কর্তৃক প্রবর্তিত হয়। মহারাজ রণজিৎ সিং (১৭৮০-১৮৩৯) যে শিখরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা এই ধারণার বশবর্তী হয়ে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পর এই ধারাই খালিস্তুান আন্দোলনে নামে। আবার এই ধারায় যারা ‘কেশধারী’ তারা অতটা অর্থোডক্স নয়, তবে বড় চুল রাখেন ও পাগড়ি পড়েন; কিন্তু অমৃতধারীদের মতো সব বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে কট্টর নন।
দশ.
শিখধর্ম অল্পসংখ্যক অনুসারীর ধর্ম হলেও গুরু নানকের পর কে গুরু হবে তা নিয়ে প্রথম থেকেই এই মতাদর্শ বহুধা বিভক্ত হয়েছে। এ ছাড়া গুরুগ্রন্থসাহিবের সংকলনও শেষ হয়েছে দশম গুরুর সময়। ইতিমধ্যে ভারতে মুসলমান শাসনের অবসান হয়েছে, ইংরেজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ধর্মীয় ব্যাখ্যাতে নতুন চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাতে গুরু অর্জুনের মৃত্যুর পর যষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং শিখ ধর্মের সামরিকায়ন করেন। তিনি ‘মিরি’ (অস্থায়ী শক্তি)ও ‘পিরি’ (আধ্যাত্মিক শক্তির) প্রকাশক বলে দুটি তরবারি ধারণ করতেন। দশম গুরু এই সামরিকায়নকে সামগ্রিক রূপ দেন। ফলে গবেষক ও ইতিহাসের নির্মোহ পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে বর্তমান খালসাপন্থীরা আদতেই গুরু নানকের আদর্শের অনুবর্তী কিনা। বহুকাল আগেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে পরাক্রমশালী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, We are not makers of history. We are made by history.
অর্থাৎ আমরা ইতিহাসের জন্ম দেই না, ইতিহাসই আমাদের সৃজন করে।
কথাটি কি শিখ দর্শন ও ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? বিষয়টি ভাববার মতো।
1.Cole, W. Owen. 2004. Understanding Sikhism. P.19. Dunedin Academic Press.
2.Suraj Prakash: https://en.wikipedia.org/wiki/Suraj_Prakash
3.Bhai Bala. https://en.wikipedia.org/wiki/Bhai_Bala
4.Singh, Kirpal. 2012. Janamsakhi Tradition – An Analytical Study. P.29. Sing Brothers publishers.
5.https://www.sikhiwiki.org/index.php/Bhai_Bala_Janamsakhi
6. উপরিউক্ত
7.Nesbitt, Eleanor. 2005. Sikhism: A very short Introduction. p. 20-21. Oxford University Press.
8.Kaur Singh, Nikky-Guninder. 2009. World Religions: Sikhism. 3rd edition. p.25-26. Chelsea House Publishers New York.
9.উপরিউক্ত
10.Cole, W. Owen. 2010. Sikhism: an Introduction. p. 37-38, 44. Teach Yourself Publishers.
11.Here is your short essay on the teachings of Kabir. See: http://www.preservearticles.com/short-essays/here-is-your- short-essay-on-the-teachings-of-kabir/10949
12.Here is your short essay on the teachings of Kabir. DcwiDউপরিউক্ত
13.Kaur Singh, Nikky-Guninder.cÖv¸³. p. 10
তথ্যপঞ্জি
1. Cole, W. Owen, Sambhi, Piara Singh. 2006 ed. The Sikhs: Their Religious Beliefs and Practices. London. Routledge and Kegan Paul.
2. Cole, W. Owen. 2004. Understanding Sikhism. Dunedin Academic Press.
3. Cole, W. Owen. 2010. Sikhism: an Introduction. Teach Yourself Publishers.
4. Judge, Paramjit. 2014. Mapping Social Exclusion in India: Caste, Religion and Borderlands, Cambridge University Press.
5. Kaur Singh, Nikky-Guninder. 2009. World Religions: Sikhism. 3rd edition. Chelsea House Publishers.
6. Nesbitt, Eleanor. 2005. Sikhism: A very short Introduction. Oxford University Press.
7. Parsons, Gerald .1994. The Growth of Religious Diversity: Britain from 1945. Routledge.
8. Singh, Khushwant.1969. Hymns of Guru Nanak. Orient Blackswan publisher.
9. Singh, Kirpal. 2012. Janamsakhi Tradition – An Analytical Study. Sing Brothers publishers.
10. Singh, Pashaura. 2003. The Guru Granth Sahib: Canon, Meaning and Authority. Oxford University Press.
11. Singh, Pashaura .2012. John Renard (ed.). Fighting Words: Religion, Violence, and the Interpretation of Sacred Texts. University of California Press.
12. Singh, Sewaram.1904. A study of the life and teachings of Sri Guru Nanak Dev. Rai Sahib M. Gulab Singh and sons.
১৩. কানিংহাম, জোসেফ ডেভিড .১৯৮৭ (বঙ্গানুবাদ). শিখ ইতিহাস, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা
১৪. চন্দ্রদাস, সুবোধ.১৪১৭ (বঙ্গাব্দ). শ্রী গুরু নানক দেব জী থেকে শ্রী গুরুগ্রন্থ সাহিব জী. ফরচুনেক্স লিমিটেড
১৫. জপজী সাহেব.গুরুদুয়ারা নানকশাহী, ঢাকা।