
প্রতীকী ছবি
সন্তান আল্লাহর দান। আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় এক আমানত। সন্তান প্রতিপালনে মা-বাবাকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। কেননা মা-বাবার আচার-আচরণ ও জীবনধারাই সন্তানকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। মা-বাবার চিন্তাচেতনা, কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক-আশাক এমনকি খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত গভীর রেখাপাত করে সন্তানের মন ও মননে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, জেনে রেখ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহাপুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই কাছে। -সূরা আনফাল (৮) : ২৮
শয়তান চায় সম্পদ ও সন্তানকে বিপথে পরিচালিত করতে। কিন্তু বান্দাকে আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন। অভিভাবকের কর্তব্য পালনের মূল পর্বটা এখানে এসেই আবর্তিত হয়।
সন্তান প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত প্রত্যেক মা-বাবান। আর এগুলো হলো- আল্লাহর সাথে মা-বাবার সম্পর্ক, সন্তানদের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক এবং অন্যদের সাথে মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্ক।
এর পাশাপাশি পরিবারে জ্ঞানের সংস্কৃতি পরিবারে গড়ে তুলতে হবে। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে মা-বাবা ও সন্তানদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে।
সন্তান পালনে আল-গাজালির প্যারেন্টিং মডেল
ইমাম আল-গাজালির Model of Parenting Skills Attributes চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গঠিত, যাতে শিশু লালনপালনের ক্ষেত্রে মা-বাবার ধর্মীর আনুগত্যের বিষয়টি প্রধান্য পেয়েছে। এই উপাদানগুলো হলো- জ্ঞান ও শিক্ষা, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, শিশুদের সাথে সম্পর্ক ও অন্যদের সাথে সম্পর্ক।
এগুলোর মধ্যে জ্ঞান ও শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি আল্লাহর সাথে পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ক, সন্তানের সাথে পিতামাতার সম্পর্ক এবং অন্যদের সাথে পিতামাতা-সন্তানের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ পরিবারে জ্ঞান অর্জনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
আল-গাজালি জ্ঞানকে অক্ষ হিসেবে ধরেছেন এবং সবকিছু তার চারপাশে ঘুরবে। আর আল্লাহর ইবাদত করাই মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। ইবাদতে পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য জ্ঞান একটি আবশ্যিক বিষয়, কারণ জ্ঞান ও মা’রিফাহ (আল্লাহর প্রতি জ্ঞান) ছাড়া ইবাদত অর্থহীন।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে হলে মা-বাবাকে তাওহিদ, তাসাউফ ও শরিয়া বা ইসলামিক আইন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে। শিশুদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে মা-বাবাকে অবশ্যই শিশুর যত্ন, বৃদ্ধি ও বিকাশের পাশাপাশি শিশুদের অধিকার সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে। এছাড়া অন্যদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে অন্যদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কেও জ্ঞান থাকতে হবে মা-বাবার।
একজন মানুষ সম্মানিত হয় তার জ্ঞান ও বুদ্ধির কারণে। আর জ্ঞান না থাকলে ধর্ম বিশ্বাস বা তাকওয়ার মর্যাদা কমে যায়। আর ধর্ম বিশ্বাস ছাড়া জ্ঞানে কোনো ভক্তি থাকে না। আধ্যাত্মিক জ্ঞান হলো মূল এবং জাগতিক জ্ঞান তার শাখা।
অন্তরের খাদ্য হলো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। খাবার যেমন শরীরকে সজীব রাখে, তেমনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা-এই দুটি জিনিস একইভাবে হৃদয়কে বাঁচিয়ে রাখে। যে সঠিকভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারে না তার হৃদয় অসুস্থ হয়ে পড়ে ও যার শেষ পরিণতি হয় মৃত্যু।
জ্ঞান ও কাজ ছাড়া সুখ কখনই অর্জিত হয় না এবং কাজগুলো কীভাবে করা হয় সে বিষয়ে জানা জ্ঞান ছাড়া অসম্ভব। ইহকাল ও পরকালের সুখের ভিত্তি হলো জ্ঞান।
সন্তানের সাথে পিতামাতা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে সন্তান লালনপালনের বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কের সাতটি অপরিহার্য উপাদান রয়েছে যা শিশুদের সাথে মা-বাবার বন্ধন সামগ্রিকভাবে বিকাশে সাহায্য করে। এগুলো হলো- বৈধ উপার্জন, সন্তানকে আদর-স্নেহ করা, সন্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা, প্রয়োজনে সন্তানকে শাসন করা, সন্তানদের মধ্যে সমান অধিকার, তাদের চাহিদা পূরণ করা ও তাদের সক্ষমতার বিকাশ ঘটানো।
পিতামাতার তাদের সন্তানকে বৈধ উপায়ে উপার্জনের অনুমতি দিতে পারেন। কারণ বৈধ উপার্জনকে ইসলামে জিহাদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল-গাজ্জালী তার বইতে লিখেছেন, ‘বৈধ উপার্জন জ্ঞানী মানুষের জন্য প্রজ্ঞার বিষয়, যা অন্যান্য অবশ্য করণীয় বিষয়ের বাইরে নয়।’
এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা উত্তম বস্তু আহার করো এবং সৎ কাজ করো। (আল-মুমিনুন:৫১)।
জ্ঞানী লুকমান (আ.) তার ছেলেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, হে প্রিয় পুত্র, দারিদ্রতা দূর করো হালাল উপার্জনের মাধ্যমে, কারণ যে দরিদ্র তার মধ্যে তিনটি অভ্যাস তৈরি হয়- অলসভাবে ধর্মীয় কর্ম, বুদ্ধির দুর্বলতা ও পুরুষত্ব হারায়।
উপার্জনে চারটি জিনিস আবশ্যক- হালাল উপার্জন, ন্যায়বিচার, দয়া ও ধর্মের ভয়।
আজকাল প্রায়ই শোনা যায় আমার সন্তান আমার কথা শুনছে না। তারা ইসলামের সঠিক পথ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ঠিকমতো নামাজ, রোজা করছে না। যেখানে প্রত্যেক মুসলিম মা-বাবা চান যে তাদের সন্তান যেন ইসলামের আদেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করবে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, যখন মা-বাবা বুঝতে পারেন যে তার ইসলামিক পথে চলা প্রয়োজন তখন তাদের বয়স হয়ে যায় ৪০ থেকে ৫০ বছর। আর তখন তারা চান তার সন্তানও সেই পথে চলুক। কিন্তু যেহেতু ইসলামের পথে আসতে তাদের সময় লেগেছে ৪০-৫০ বছর, তাহলে তারা কিভাবে আশা করতে থাকেন যে তাদের সন্তানরা ১২-১৩ বছর থেকেই ইসলামের পথে আসবে।
যেহেতু মা-বাবা প্রথম থেকেই তাদের সন্তানকে ইসলামিক শিক্ষা দিতে পারেননি, তাই তারা আশা করতে পারেন না যে কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের সন্তানরা ইসলামের পথে আসতে পারবে। প্রায়ই দেখা যায় রোজা রাখতে বলতে বা নামাজ আদায় করতে বললে সন্তানদের সাথে মা-বাবার তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে বা মনোমালিন্য হচ্ছে। কারণ তারা ছোট থেকে যেভাবে বড় হয়েছে তাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়।
যদি সন্তানকে সঠিক পথে আনতে হয় তাহলে মা-বাবাকেও সঠিক পথে আসতে হবে। যখন কেউ মা-বাবা হন, তখন তার নিজের অজান্তেই সন্তানরা তাদের প্রতি মুহূর্তে অনুসরণ করতে থাকে। কিভাবে তারা কথা বলেন, তারা কিভাবে অন্যদের সাথে আচরণ করেন তা ছোটবেলা থেকে তাদের অন্তরের মধ্যে ঢুকে যায়।
সুতরাং ইসলামে সন্তান পালনের যেসব বিষয় আছে সে সম্পর্কে মা-বাবাকে অবগত হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ নিজে বল্গাহীন জীবনযাপন করে সন্তানকে কখনোই সুশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত করা সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘প্রতিটি শিশুই সুস্থ প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মূর্তিপূজারুতে পরিণত করে। যেমন চতুষ্পদ জন্তু চতুষ্পদ জন্তুই প্রসব করে।’ বুখারি : ১৩৮৫
কিছু বিষয়ের উপর যদি আমরা আলোকপাত করি তাহলে কিছুটা হলেও আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিক পথে আনার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।
১. প্রথমত আমাদেরকে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ওপর মনোনিবেশ করতে হবে এবং জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
২. কুরআন ও সুন্নাহর অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে এবং সেভাবে সন্তানদের অনুপ্রাণিত করতে হবে যাতে তারাও তাদের জীবনে সেই অনুযায়ী অতিবাহিত করতে পারে।
৩. মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার সময়। মা-বাবাকে তাদের সময়ের মূল্য বুঝতে হবে এবং সন্তানকেও সেভাবে সময়ের মূল্য বোঝাতে হবে। সন্তানদের সাথে কোয়ালিটি সময় কাটাতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে। তাদের বিভিন্ন বিষয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি বোঝাতে হবে।
৪. সন্তানদের অন্য শিশুদের সাথে তুলনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ প্রতিটা মানুষকে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা বিশেষ ক্ষমতা ও দক্ষতা, জ্ঞান ইত্যাদি দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন।
৫. পরিবারের অন্যান্য সদস্য ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, সবাইকে সম্মান করতে হবে এবং প্রতিবেশীর হক পালন করতে হবে। যাতে সন্তানরা তাদের জীবনে এই জিনিসগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং তাদেরও সম্মান করতে পারে।
৬. বর্তমান সমাজে যে অনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে তার থেকে নিজেকে সংযুক্ত করতে হবে এবং সন্তানদের বোঝাতে হবে।
৭. মা-বাবার উচিত বস্তুবাদী জীবন ও স্বার্থপরতা থেকে বিরত থাকা, হালাল-হারাম বেছে চলা, হালাল রোজগার করা, স্নেহময় সম্পর্ক গড়ে তোলা।
৮. মা-বাবার উচিত সন্তানের জন্য নির্ভরতার একটা জায়গা গড়ে তোলা, যেখানে সন্তান তার মা-বাবার সাথে তার বিভিন্ন অসুবিধার কথা শেয়ার করতে পারে।
শিশুদের সুশিক্ষিত করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন। এ ব্যাপারে মা-বাবাকে সর্বদা সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত এবং অন্যদেরকে ভালবাসতে হবে যেমন তারা নিজেকে আল্লাহর নামে ও তার অনুগ্রহে ভালবাসে।
আল-গাজালি তার বইতে লিখেছেন, বন্ধুত্ব হলো একে অপরের প্রতি ভালো ভালোবাসার ফল। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১১)
নোমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘সব মুমিন দেহের মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নসীহতগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, শিশুর জীবন গঠনের জন্য তিনি যে বিষয়টির প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন তা হলো- আল্লাহর সাথে শিশুর সম্পর্ক কায়েম করে দেওয়া। শিশুর জীবন সরল পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য এর চেয়ে সহজ ও সুন্দর পদ্ধতি আর কী হতে পারে!