
প্রতীকী ছবি
ব্যবসা করা মহৎ পেশা। ইসলামে ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন উপার্জন সবচেয়ে উত্তম? নবীজি বললেন, বরকতময় ব্যবসা ও পুরুষের হাতের উপার্জন।’
রিজিকের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি ইসলাম। তবে যে পেশাই অবলম্বন করা হোক তা যেন হালাল হয় সেটার ওপরই জোর দিয়েছে ইসলাম। রাসূল (সা.) বলেন, ‘ফরজ ইবাদতসমূহের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।’
ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি
ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে ইসলাম। ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা, অন্যের কাছে যা আছে তার লোভ থেকে বিরত থাকা, হালাল উপার্জনে সন্তুষ্ট থাকা, দ্বীনের পথে রোজগার করা এবং সংসার চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবসা করা উচিত। ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার ও ইহসানের পথ অনুসরণ করুন এবং ব্যবসায় ভালো কাজের আদেশ করুন ও মন্দ কাজে নিষেধ করুন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা কর তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)
ব্যবসা-বাণিজ্যের ফজিলত
ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে হবে ফরজে কিফায়াহর মতো দায়িত্ব পালনের নিয়ত করে। যদি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা ও শিল্পকারখানা তৈরি না করা হয় মানুষের জীবন পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একেক জন মানুষ একেক ধরনের কাজ করবে। সবাই যদি এক ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকে তাহলে অন্য কাজগুলো নিরর্থক হয়ে যাবে এবং মানুষ বিলোপ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, আমার উম্মতের বৈচিত্র্যময়তা হলো একটি আশীর্বাদ।
রিজিকের ১০টি অংশ; এর মধ্যে ৯টি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিহিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পেশাদার মুসলমানকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন।’ হাদিসে আছে- কাপড়ের ব্যবসা সব ব্যবসার মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সেলাইয়ের কাজ সকল শিল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অন্য হাদিসে আছে- জান্নাতীদের যদি ব্যবসা থাকত, তবে তারা কাপড়ের ব্যবসা করত। জাহান্নামীদের যদি কোন ব্যবসা থাকত, তবে তারা মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসা চালিয়ে যেত।
ইবাদত ভুলে না যাওয়া
ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থের মোহে পড়ে আল্লাহকে ভুলে গেলে হবে না; বরং ইসলামের মৌলিক ইবাদত-বন্দেগি যেমন—নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত যথাসময়ে আদায় করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘এমন সব (পুরুষ) লোকও রয়েছে যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠায় ও যাকাত দেওয়া থেকে বিরত রাখে না; তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি ভীতি-বিহব্বল হয়ে পড়বে।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩৭)
আল্লাহ আরো বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্ৰতা ও মহিমা ঘোষণা কর। (৩৩) আল-আহযাব
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা হলো বাজার ও মার্কেট। এটি এমন একটি জায়গা, যা মানুষকে আল্লাহর জিকির ও ইবাদত থেকে ভুলিয়ে রাখে। মানুষের অধিক দুনিয়াপ্রীতির কারণে বাজারগুলো হয়ে উঠেছে ধোঁকা-প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচার, বিশ্বাসঘাতকতা ও পাপাচারের স্থান। তাই দিনের প্রথমভাগে কাজের সময় পর্যন্ত পরকালের জন্য কাজ করা উচিত এবং দিনের কর্মব্যস্ততার পর আল্লাহর সেবায় ব্যস্ত থাকা উচিত। হাদিসে আছে, যদি ফেরেশতারা আমলের লিপিবদ্ধ করে তাতে দিনের প্রথম ও শেষ অংশে আল্লাহর জিকির ও নেক আমল লিখলে আল্লাহ এই দুই সময়ের মধ্যকার গুনাহ মাফ করে দেন। হাদিসে আছে, সকাল ও আসরের নামাজের সময় দিন ও রাতের ফেরেশতারা একে অপরের সাথে মিলিত হন। তখন আল্লাহ বলেন, তুমি আমার বান্দাদের কি অবস্থায় পেয়েছ? তারা বলেন, আমরা তাদের সালাত আদায় করতে দেখেছি এবং তাদের কাছ থেকে প্রার্থনারত অবস্থায় এসেছি। আল্লাহ বলেন, আমি আপনার সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আমি তাদের ক্ষমা করেছি।
সবসময় জিকির করা
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজের পাশাপাশি আল্লাহর জিকির করতে হবে। হাটবাজারে আল্লাহকে স্মরণ করা উত্তম। রাসুল (সা.) বলেছেন, গাফিলদের মধ্যে আল্লাহকে স্মরণ করা হলো- পালাতে থাকা শত্রুর পেছনে ছুটে যাওয়া যোদ্ধার মতো অথবা মৃতদের মাঝে একজন জীবিত ব্যক্তির মতো। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, শুকনো গাছের মাঝে জীবন্ত বৃক্ষের মতো। রাসুল (সা.) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের পর এই কথাগুলো বলেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ইয়ুহয়ি ওয়া ইউমিতু বিয়াদিহিল খাইর, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির; অর্থ-‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, একক, তাঁর কোনো শরীক নেই, তাঁরই রাজত্ব এবং তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা, তিনি জীবন দান করেন এবং জীবন গ্রহণ করেন, তিনি চিরন্তন এবং মৃত্যুবরণ করবেন না, তাঁর হাতেই রয়েছে কল্যাণ এবং তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’- আল্লাহ তাকে হাজার হাজার গুণ বেশি পুরস্কার দেবেন।
হযরত ওমর (রা.) বলেন, হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে কুফর ও যাবতীয় পাপ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। রাসুল (সা.) বলেছেন, তুমি যেখানেই থাক না কেন আল্লাহকে ভয় কর। যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য মার্কেট মসজিদ এবং ঘর সবই সমান। তারা আল্লাহর জন্য বাঁচে এবং আল্লাহর জন্যই মৃত্যুবরণ করেন এবং আল্লাহই তাদের জীবনের মূল ভিত্তি।
লোভ না করা
ব্যবসার ক্ষেত্রে খুব লোভী হওয়া যাবে না। যারা ব্যবসা করবেন, তাদেরকে সততা, আমানতদায়িতা ও তাকওয়া রক্ষা করতে হবে। যারা সৎ পথে ব্যবসা করেন, তারা দুনিয়া-আখেরাতে প্রভূত কল্যাণ ও বরকত লাভ করেন। সৎ ব্যবসায়ী পরকালে নবী ও সিদ্দিকগণের সাথে থাকবেন। হযরত আবু সাঈদ (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবেন।’ (তিরমিজি : ১২০৯)
হাম্মাদ নামে এক ব্যক্তি পশমের কার্পেটের ব্যবসা করতেন, তিনি প্রায় ছয় আনা মুনাফা করতে পারলেই বিক্রি বন্ধ করে দিতেন।
হারাম জিনিস ত্যাগ ও সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে
হারাম জিনিস ত্যাগ করার পরও সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে। সন্দেহজনক জিনিস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সন্দেহজনক কোনো কর্মস্থল ত্যাগ করতে হবে। একবার এক ব্যক্তি নবীজির কাছে দুধ নিয়ে এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার কাছে এ দুধ কোথা থেকে এসেছে? তিনি বলেন, আমরা ছাগল থেকে পেয়েছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছাগল কোথা থেকে পেলে। তিনি বললেন, অমুক অমুক জায়গা থেকে। তারপর তিনি তা পান করলেন এবং বললেন, আমরা নবীদের সম্প্রদায়। আমাদেরকে ভালো জিনিস আহার করতে এবং নেক আমল ব্যতীত অন্য আমল করতে নিষেধ করা হয়েছে। এরপর তিনি বলেন, মুমিনদেরকে সেই কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যা করার জন্য নবীকে আদেশ করা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর করো, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো’ সুরা বাকারা আয়াত ১৭২। নবী (সা.) অত্যাচারী, বিশ্বাসভঙ্গ, চুরি ও সুদের সাথে যার সম্পর্ক আছে তার সাথে ব্যবসা না করতে বলেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি অত্যাচারীর দীর্ঘায়ু কামনা করে, সে দুনিয়াতে আল্লাহর অবাধ্য হতে পছন্দ করে। যখন কোনো সীমা লঙ্ঘণকারীর প্রশংসা করা হয় তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘণকারীকে সম্মান করে সে ইসলামের ধ্বংসে সাহায্য করে।
সবার সাথে ব্যবসার হিসাবে স্বচ্ছতা রাখা
কেয়ামতের দিন সবার সাথে আপনার ব্যবসার হিসাব নেওয়া হবে। এক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন, আমি একজন ব্যবসায়ীকে স্বপ্নে জিজ্ঞাস করলাম- আল্লাহ তোমার কি ব্যবস্থা করেছেন? তিনি বললেন, আমার সামনে ৫০ হাজার খাতা খোলা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- এ সব কি গুনাহের আমলনামা? তিনি বললেন- পৃথিবীতে আপনি যে ব্যক্তির সাথে লেনদেন করেছেন সেগুলো রেকর্ড করা হয়েছে। এসব হিসাব ওই ৫০ হাজার খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ব্যবসায়িক যে কোনো লেনদেন ও কারবারের ক্ষেত্রে আল্লাহ সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন- ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেন-দেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে। আর তোমাদের মধ্যে একজন লেখক যেন ইনসাফের সাথে লিখে রাখে এবং কোন লেখক আললাহ তাকে যেরূপ শিক্ষা দিয়েছেন, তা লিখতে অস্বীকার করবে না। সুতরাং সে যেন লিখে রাখে এবং যার উপর পাওনা সে (ঋণ গ্রহীতা) যেন তা লিখিয়ে রাখে। আর সে যেন তার রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং পাওনা থেকে যেন সামান্যও কম না দেয়। অতঃপর যার উপর পাওনা রয়েছে সে (ঋণ গ্রহীতা) যদি নির্বোধ বা দুর্বল হয়, অথবা সে লেখার বিষয়বস্ত্ত বলতে না পারে, তাহলে যেন তার অভিভাবক ন্যায়ের সাথে লেখার বিষয়বস্ত্ত বলে দেয়। আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী রাখ।’ সুরা বাকারা- ২৮২
মুসলমানদের উচিত নবীজি (সা.)-এর ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত নির্দেশনা অধ্যয়ন করা। ইসলামের নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলা। আল্লাহ সবাইকে নবীর সুন্নত ব্যবসাকে আপন করে নেয়ার এবং মন দিয়ে ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবসা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।