রহমত-মাগফেরাত-নাজাতের মাস

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অফুরন্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অমিয় বারতা নিয়ে আগমন করেছে ১৪৪৬ হিজরির মাহে রমজানুল মুবারক। সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিবৃত থাকা। ইসলামি  শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে নিবৃত থাকার নাম সিয়াম। রমজানের পুরো মাস সিয়াম পালন করা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের একটি।

মহানবী (সা.) মক্কা থেকে  হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পর দ্বিতীয় বছরে  মাহে রমজানের এই বিশেষ বিধান নিয়ে নাজিল হয় কোরআন মজিদের সুরা বাকারার  ১৮৩ ও ১৮৪ নং আয়াত। ইরশাদ হয়, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হলো, যেমনভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের ওপর- এই আশায় যে, তোমরা মুত্তাকি হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন। আর যে কেউ অসুস্থ হয় কিংবা সফরে থাকে, তার জন্য অন্যান্য দিন থেকে এই সংখ্যা (পূরণ করা কর্তব্য)। আর যারা এতে অক্ষম হয়, তাদের কর্তব্য  ফিদয়া আদায়  অর্থাৎ দরিদ্রকে খাবার দেওয়া।যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো কল্যাণ কাজ করবে, সেটি তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর তোমরা রোজা রাখবে, এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে।’

তারিখে ইবনে জরীর ও আলবিদায়া ওয়ান নিহায়ায় বলা হয়েছে, হিজরি দ্বিতীয় সনের ১০ শাবান  ফরজ হয় রমজানের রোজা। এ বছরেই রমজানের আগে  কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসে। এর আগে নবী করীম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম আশুরা বা মহররম মাসের ১০ তারিখ ও আইয়ামে বীজ বা প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন। বোখারি শরিফে হজরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনা আছে। তিনি বলেন, আশুরার দিনে কুরাইশরা ইসলামপূর্ব যুগে রোজা রাখত। আল্লাহর রাসুলও ইসলামপূর্ব যুগে এদিনে রোজা রাখতেন। যখন  তিনি মদিনায়  এলেন, তখন তিনি এদিনে রোজা রাখলেন এবং রোজা রাখতে আদেশ দিলেন। তারপর যখন রমজান ফরজ হলো, তখন  তিনি আশুরার দিনটি ছেড়ে দিলেন। ফলে যে চাইল রোজা রাখল, আর যে চাইল ছেড়ে দিল।

অবশ্য রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পরে আশুরা বা অন্য কোনো রোজা ফরজ নেই বলে সর্ববাদী সম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুধু প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সিয়াম পালন এমন একটি ইবাদত, যা রমজানের আগেও প্রচলিত ছিল। তবে রমজান মাসের সঙ্গে নির্ধারিত ছিল না।

তিরমিজি শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বরাতে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, রমজানের প্রথম রাত এলে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শিকলবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কোনো দরজা আর খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এরপর কোনো দরজা আর বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, হে কল্যাণপ্রার্থী, তুমি এগিয়ে এসো। আর হে অকল্যাণ প্রত্যাশী, তুমি নিবৃত্ত হও। আল্লাহ অনেককে মুক্তি দেবেন। প্রতিটি রাতে এভাবে ঘোষণা চলতে থাকে।

নেক কাজে উদ্যোগী হওয়া ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সব সময়ই জরুরি। কিন্তু এ মাসে তাতে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর অপার রহমত নাজিল হওয়ার মাসে নেক কাজ সম্পাদন ও অন্যায় কাজ বর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ভাগ্যবানদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষ করে তাকওয়া অর্জনের যে উদ্দেশ্য সিয়াম পালনের মধ্যে নিহিত, তা সফল হতে হলে রমজানের প্রথম মুহূর্ত থেকেই সযত্নে চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া।

রমজানের এই সিয়াম পালনকে ইসলামের অন্যতম ভিত্তি বলে ঘোষণা করেন মহানবী (সা.)। হাদিসের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বোখারি ও মুসলিম শরিফসহ বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত আল্লাহর নবীর বাণীতে বলা হয়েছে, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি- এই মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে যে আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, সালাত কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, হজ করা ও রমজানের সিয়াম আদায় করা।

আয়াত ও হাদিসের দ্বারা রমজানের সিয়াম পালন যেমন আবশ্যিক বলে প্রমাণিত হয়, তেমনি এই ইবাদতটির অসাধারণ মাহাত্ম্য ও প্রতিদানের সুসংবাদও দেওয়া হয়েছে। সিয়ামের বিধান নিয়ে আয়াত নাজিল হলে রমজানের আগমনের প্রাক্কালে সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ করে এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)। এতে তিনি এই মাসের তাৎপর্য ও শিক্ষার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছিলেন।  বায়হাকি শরিফে হাদিসটি সংকলিত হয়েছে। হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) শাবানের শেষে একদিন আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে লোকেরা, তোমাদের মাথার ওপর এসে পড়েছে এক মহান মাস, এক কল্যাণময় মাস। এমন মাস, যাতে রয়েছে এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এক রজনী। আল্লাহ এ মাসের রোজা রাখাকে করেছেন ফরজ, আর রাতের দাঁড়ানোকে (ইবাদত) করেছেন ঐচ্ছিক। যে ব্যক্তি এতে  কোনো নেক কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। আর যে ব্যক্তি এতে একটি ফরজ আদায় করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রয়েছে পাপমোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং রোজাদারের মতোই তাকে প্রতিদান দেওয়া হবে। কিন্তু রোজাদারের প্রতিদান কমানো হবে না। প্রশ্ন করা হলো হে আল্লাহর রাসুল, রোজাদারকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের প্রত্যেকের নেই। তিনি বললেন, যে কেউ কোনো রোজাদারকে একটু দুধ, একটি খেজুর কিংবা একটু পানীয় দিয়ে ইফতার করাবে, তাকেই আল্লাহ তাআলা এই প্রতিদান দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্ত করে আহার করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে হাউসে কাওছার থেকে পানি পান করাবেন। 

এ মাসের প্রথমভাগে রহমত, মধ্যভাগে মাগফিরাত ও শেষভাগে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এটা ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। নেক কাজে উদ্যোগী হওয়া ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সব সময়ই জরুরি। কিন্তু এ মাসে তাতে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর অপার রহমত নাজিল হওয়ার মাসে নেক কাজ সম্পাদন ও অন্যায় কাজ বর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ভাগ্যবানদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও পাপকার্য থেকে বিরত রইল না তার রোজা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বোখারি শরিফ)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh